বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুল ইসলামের সাক্ষাৎকার- An interview of Mahidul Islam, a famous recitation artist of BD.

আবৃত্তি কণ্ঠে ধারণ করতে চাই শেষ দিন পর্যন্ত : মাহিদুল





মাহিদুল ইসলাম। একজন স্বনামধন্য আবৃত্তি শিল্পী। জন্ম  ১৯৬৯ সালের ২৬ আগস্ট বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে। বাবা আব্দুল কুদ্দুস এবং মা লতিফা বেগম। বাংলাদেশে আবৃত্তিশিল্প প্রসারে তিনি কাজ করছেন নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন থেকে। এ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি আবৃত্তির অ্যালবাম বেরিয়েছে তার। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও  আবৃত্তি করে এসেছেন গুণী এই শিল্পী। পেশা মুদ্রণ ব্যবসা হলেও নেশা তার আবৃত্তি। সম্প্রতি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জেমস আনজুস।


জেমস আনজুস : আবৃত্তির প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলো কীভাবে?

মাহিদুল ইসলাম : ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকারবিরোধী যে আন্দোলন চলেছিল তখনই আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। সে সময় মানুষের ভেতরের আকাঙ্ক্ষা ছিল সামরিক সরকার হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমি তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন কর্মী। আবৃত্তি করতে করতে যখন দেখলাম, মানুষকে আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করতে পারছি, তখনই ভেতরে এক ধরনের জাগরণ তৈরি হয়। আসলে মানুষের ভালোবাসাই সে সময় আমাকে আবৃত্তি করতে সাহসী করে তোলে।

জেমস আনজুস: তখন থেকেই কি আবৃত্তির প্রতি পুরোপুরি নিবেদিত হলেন?

তখন থেকেই আবৃত্তি শেখা, আবৃত্তিশিল্পের প্রতি আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে আমার। আবৃত্তি আমার প্রাত্যহিক অবশ্যকরণীয় হয়ে ওঠে।
অতীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে আবৃত্তি শিল্পীরা একটা অবস্থান নিয়ে রাজপথে নামতেন। এখন আনন্দোলনের রূপটা কেমন? 

গণমানুষের দাবিদাওয়া ও আকাঙ্ঙ্ক্ষা যখন যৌক্তিক হয় এবং বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়, তখন অবশ্যই সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আবৃত্তি শিল্পীরাও রাজপথে নামেন। কোনো রাজনীতি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আবৃত্তি কখনোই একাত্মতা প্রকাশ করেনি, করবেও না। তবে যে কবিতায় সমাজচিত্র বা মানবিকতার বিকাশ থাকে, আবৃত্তিশিল্পীরা সে ধরনের কবিতাই আবৃত্তিতে রূপান্তর করে। একজন মানুষকে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন করে তোলার দায়বদ্ধতা আবৃত্তি শিল্পীদের সব সময় ছিল, আছে এবং থাকবে। একজন আবৃত্তিকার সমাজ বা রাষ্ট্র পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন না। তিনি শুধু মানুষকে সচেতন করেন মাত্র।

জেমস আনজুস: বাংলাদেশে আবৃত্তিচর্চার পটভূমি নিয়ে খানিকটা বলবেন?

দেশ স্বাধীনের আগে বিছিন্নভাবে নাটক বা আবৃত্তি চর্চা হতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতে গণসংগীত ও কথিকা পাঠের পাশাপাশি আবৃত্তি করা হতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যখন মঞ্চ নাটক বিকশিত হয়, তখনো সেই নাট্যশিল্পীরাই সমান্তরালে আবৃত্তি করতেন এবং যা ছিল বিচিত্রা অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ। আবৃত্তি তখনো আলাদা শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আশির দশকে আবৃত্তিচর্চার নিজস্ব ধারা তৈরি হলো। আলাদা সংগঠন হলো। নব্বইয়ের সামরিক সরকার পতনেও আবৃত্তিশিল্পীদের ভূমিকা চিহ্নিত করা গেল আলাদা করে। তখনই মূলত আবৃত্তি সাংগঠনিক রূপ নেয়। এখন আবৃত্তি স্বয়ম্ভু একটি শিল্প এবং সাংগঠনিক চর্চার জায়গা।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির ক্ষেত্রে যেন কিছু কবিতারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আবৃত্তি করার মতো নতুন কবিতা কি লেখা হচ্ছে না?

বাঙালির জীবনধারার সঙ্গে কবিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যত দিন বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি থাকবে, তত দিন বাংলা কবিতা রচিত হবে। আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করবেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সব শিল্পের আঙ্গিক বা রূপ বদল হবে। বর্তমানে উত্তরাধুনিক কবিতার যুগ চলছে। এখনকার কবিরা যে আঙ্গিকে কবিতা লিখছেন, আবৃত্তিশিল্পীরা হয়তো সেভাবে কণ্ঠে ধারণ করছেন না। তবে ভালো কবিতা অবশ্যই রচিত হচ্ছে। বাংলা ভাষায় অতীতে যে কবিতা রচিত হয়েছে, আবৃত্তিশিল্পীরা সেই কবিতা এখনো আবৃত্তি করে শেষ করতে পারেননি। এখন যেসব কবিতা রচিত হচ্ছে কিছুদিন পর হয়তো সেগুলো আবৃত্তি করা হবে। তবে সেগুলো যে একেবারে আবৃত্তি হচ্ছে না, তা নয়। আমরা সমসাময়িকদের কবিতাও আবৃত্তি করছি।

জেমস আনজুস: অতীতে আবৃত্তির যে আঙ্গিক ছিল আর বর্তমানে যে আঙ্গিক, তাতে কি কোনো পালাবদল হয়েছে?

আবৃত্তির আঙ্গিকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সত্তর থেকে আশির দশকের আবৃত্তির আঙ্গিক অনেকটাই বদলে গেছে। এখনকার আবৃত্তি অনেক বেশি সংবেদনশীল। সাধারণ মানুষের কাছে এখনকার আবৃত্তি অনেক বোধগম্য। কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা এখন সবাই খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। আমার কাছে মনে হয়, এখন আবৃত্তির যে ফর্মটা প্রচলিত, এটা দীর্ঘায়িত হবে। আমার বিশ্বাস, তা সর্বজনীনও হবে ভবিষ্যতে।



জেমস আনজুস: সব কবিতাই কি আবৃত্তি করা যায়?

না। সব কবিতা আবৃত্তি করা যায় না। ধরুন, পাখি যে গান গায়, খুব সুন্দর করে গায়। তবু কেউ শুনল কেউ শুনল না- পাখি কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু আবৃত্তিশিল্পী যদি আবৃত্তি করেন, আর তা কেউ যদি না  শোনেন তা হবে পাগলের প্রলাপ। যে কবিতা মানুষকে আকৃষ্ট করে, যে কবিতায় মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটে, তাকে আন্দোলিত করে সেটিই আবৃত্তি করেন একজন আবৃত্তিশিল্পী। কবিতার বক্তব্য যদি দুর্বল হয়, কবিতায় যদি বার্তা, দিকনির্দেশনা, সমাজসচেতনতা না থাকে, তাহলে তো সে কবিতার আবৃত্তিই নিরর্থক। তা  আবৃত্তি করলে মানুষ কেন শুনবে?

জেমস আনজুস: আপনার প্রিয় কবি কে? কার কবিতা আবৃত্তি করতে ভালো লাগে?

যেকোনো ভালো কবিতাই ভালো লাগে আমার। যেটা আবৃত্তি করলে বেশিরভাগ শ্রোতাকে আকৃষ্ট করা যায়, সে ধরনের কবিতাই আমি আবৃত্তি করি। কারণ, আমার সময়ের এবং শ্রমসাধনার একটা তুল্যমূল্য আমি দাঁড় করাতে চাই। বিষয়ভিত্তিক বললে বলব, যে কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধ রয়েছে, যে কবিতা মানুষের চেতনায় একটুখানি হলেও আঘাত করে, সে কবিতাই আমি বেছে নিই।

জেমস আনজুস: আমাদের দেশে আবৃত্তির বর্তমান অবস্থা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?  

বর্তমানে দেশে সার্বিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অস্থিরতা রয়েছে। সে রকম একটি দেশে অন্যান্য যেসব বিকশিত শিল্প রয়েছে, তার পাশাপাশি আবৃত্তিশিল্প বেশ গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা এবং এর বিকাশ চলছে। আস্তে আস্তে পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে এ শিল্পের। শ্রোতা বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যায়নও। আমি মনে করি, সঠিক পথেই রয়েছে বাংলাদেশের আবৃত্তি। আর বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এভাবে আবৃত্তি চর্চা হয় না।

জেমস আনজুস: শিল্প হিসেবে আবৃত্তির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেন?

বাংলাদেশেই হবে একটা নতুন যুগের সূচনা, যেখানে আবৃত্তি একটা পেশাদার শিল্প হিসেবে দাঁড়াবে। তবে একটু কঠিন হবে। কারণ এর ক্যানভাসটা বেশি বিস্তৃত না। দর্শক-শ্রোতা অনেক বেশি বিস্তৃত না। এর পৃষ্ঠপোষকতাও যথেষ্ট না। সে কারণেই আবৃত্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে নেওয়া একটু কঠিনই হবে। তবু আমি মনে করি, এ দেশে আবৃত্তিশিল্প একদিন পেশা হিসেবে দাঁড়াবে, যদি তরুণ মেধাবী প্রজন্ম আরো বেশি সাহসী হয়।

জেমস আনজুস: আবৃত্তিশিল্পে সাংগঠনিক চর্চার অবদান খুবই উজ্জ্বল, বর্তমানে কেমন চলছে সংগঠনগুলো?

সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চায় আবৃত্তিকর্মীরা অনেক বেশি সংগঠিত, অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। তারা লাভ-লোভ-স্বার্থ-মোহমুক্ত। তারা শিল্পের প্রতি নিবেদিত হয়েই কেবল বারবার সংগঠিত হন।

জেমস আনজুস: সম্প্রতি  শিল্পকলা একাডেমীতে নতুন বিভাগ হিসেবে আবৃত্তি যুক্ত হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

আবৃত্তিকর্মীরা এত দিন নিজেদের গড়া বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আবৃত্তি করে চলছিলেন। এখন হয়তো আবৃত্তির জন্য সরকারি একটা ভীত স্থাপিত হলো। এটা সরকারের স্বীকৃতি বলা যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরো বাড়বে। তবে আমি মনে করি, আবৃত্তিশিল্পের বিকাশ এর সাংগঠনিক চর্চার ওপরই নির্ভর করবে।

জেমস আনজুস:আবৃত্তির জন্য নিজের স্বীকৃতি বা সম্মাননা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...

বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময় নানা রকম স্মারক বা স্বীকৃতি দিয়েছে আমাকে। তবে এসব নিয়ে আমি খুব একটা উচ্ছ্বসিত বা আন্দোলিত নই। ভালোবাসার টানেই আবৃত্তি করি, আবৃত্তি কণ্ঠে ধারণ করতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কোথাও নেই- ওস্তাদ পি. সি. গোমেজ (গমেজ)

পি.সি. গমেজ রচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ - †Rgm AvbRym evsjv‡`‡ki cÖL¨vZ D”Pv½m½xZ wkíx cvm Kvjm Pvj©m M‡gR(wc. ...