অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে, মানসিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো উচিত : শিমুল মুস্তাফা
এদেশের একজন জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মোস্তফা। ১৭ অক্টোবর ঢাকায় তার জন্ম। তার বাবা প্রয়াত খান মোহম্মদ গোলাম মোস্তফা এবং মা আফরোজ মোস্তফা। আবৃত্তি তার পেশা নয়, নেশা। ঘেরতর নেশা। আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। কন্ঠে আওয়াজ তোলেন। তার ভয়হীন কন্ঠ আজও ভয়হীন। শিল্প তার কাছে প্রার্থনা, সেটি শিল্পের যে মাধ্যমই হোক না কেন। একজন দূরন্ত, দুর্নিবার এবং চির আপোষহীন মানুষ শিমুল মোস্তফা। তার এই সাক্ষাৎকারটি শুধুমাত্র আবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিল্পের বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যম এবং শিল্পীর নৈতিক ও মানসিক মূল্যবোধের দার্শনিক অভিপ্রায় একই বৃত্তে উঠে এসেছে। তিনি এপর্যন্ত প্রায় ৪০টির মত আবৃত্তি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জেমস আনজুস।
জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি ভাল লাগাটা কিভাবে তৈরি হল?
শিমুল মুস্তাফা : এটা তো কোন আয়োজন করে হয় না। আস্তে আস্তে বিষয়টি ঘটে যায়। আমার পারিবারিক বন্ধনই ছিল শিল্পমনা। আমার মা বাবা দুজনেই চারুকলার ছিলেন। তাই পরিবারেই একটি শিল্পের আবহ ছিল ।
জেমস আনজুস: কবিতা ও আবৃত্তি- শিল্পের দুটি মাধ্যমকে কিভাবে বিবেচনা করবেন।
শিমুল মুস্তাফা : কবিতা এবং আবৃত্তির সম্পর্ক অনেকটা মা-মাসির মত। আমি এটাই বলি কবিতা জন্ম দেন কবি, তিনি মা। আর কিন্তু আবৃত্তিকাররা কবিতার মাসি অন্তত। জনক না হলেও স্নেহের জায়গাটা, প্রেমের জায়গাটা, আন্তরিকতার জায়গাটা, লালনের জায়গাটা একটা আবৃত্তিকারের কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। কবিতা হচ্ছে বোধের জায়গাটা তৈরি, মানুষকে উপলব্ধি করার জায়গাটা। আমি কবিতাকে এভাবেই ধারণ করি। কবিতা ভালবেসেই পড়ি। আমি যা পড়ি তা বিশ্বাস করি। যেমন ভাল লাগল একটি কবিতা , কিন্তু আমার আদর্শের সাথে মেলেনা , আমি সে কবিতা পড়ি না। আবৃত্তি কন্ঠের শিল্প নয়, মস্তিষ্কের শিল্প। কন্ঠ হচ্ছে একটি সাউন্ড বক্সের মত। মস্তিষ্ক যদি পরিশিলীত না হয়, সাউন্ড বক্স নিজে নিজে আর কি রকম বাজতে পারে? আমার মস্তিষ্কে যে বোধ এবং দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে, সেটাই আমি কন্ঠ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি।
জেমস আনজুস: বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার পটভূমি নিয়ে যদি কিছু বলেন..
শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি চর্চার ব্যাপারটা আসলে স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়। কিন্তু আমি বলব আবৃত্তির মূল বহিঃপ্রকাশ গোলাম মোস্তফা, ইকবাল বাহার চৌধুরী, হাসান ইমাম এদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয়। এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে আবৃত্তি সেই অর্থে ভূমিকা না রাখলেও মধ্য সত্তরের দিকে কাজী আরিফ, জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় সাথে প্রবীন যে আবৃত্তি শিল্পীদের কথা বললাম এরা মিলে আবার আবৃত্তি চর্চা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সত্তরের দশকের রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটের কারণে শিল্প চর্চায়ও একটি ধ্বস নেমে আসে। কারণ আমরা দেখেছি দেশের ক্রান্তিকালে শিল্পীরা তাদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী করে ফেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য পচাত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত শিল্পকলার প্রত্যেকটি মাধ্যম সেই ভাবে জেগে উঠতে পারেনি। অনেকটাই আস্থাহীন, হতাশায় পড়ে গিয়েছিল শিল্পীরা। আমাদের বিগত দু’শত বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আমরা যেভাবে রুখে দাড়িয়েছি, কিন্তু এই পাঁচ বছর আমাদের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন মিডিয়া যে ভাবে কাজ করছে, তখন তো এত মিডিয়া ছিল না। আর যেগুলো ছিল সেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করেছে। ফলে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল।
জেমস আনজুস: নব্বইয়ের গন আন্দোলনে আবৃত্তির তো বিরাট ভূমিকা ছিল...
শিমুল মুস্তাফা : একাশির পর আবার নতুন করে প্রেরণা, অনেক সাহস, নতুন উদ্দিপনা, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে শিল্পকলায় আমাদের অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এবংএরই ধারাবাহিকতায় খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে আমাদের থিয়েটার এবং সাথে সাথে আবৃত্তি। তখন সংগীত যতটা না সক্রিয় হয়ে ওঠে, থিয়েটার এবং আবৃত্তি অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। সেই সময় পথনাটক কর্মীরা, মঞ্চ নাটক কর্মীরা রাজপথে ছিলে, তবে নেতৃত্বে ছিল আবৃত্তি শিল্পীরা। আবৃত্তিতে সে সময় যে পরিবর্তন আসে, তা হল আমাদেরকে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী যে শৃঙ্খলিত করে রাখার পায়তারা ছিল তার বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলি। এরই সাথে সাথে কবিরাও সোচ্চার হয়ে উঠে। স্বৈরাচারি সরকার হটাতে তারাও উদগ্রিব হয়ে ওঠে। তারই ফলশ্রুতিতে মধ্য আশিতে তৈরি হয় কবিতা পরিষদ। এবং শুরুতেই তখন বলা হয়েছিল যে, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এই কথা প্রথম কবিরাই প্রকাশ করে। তার বছর দুয়ের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় আবৃত্তি উৎসব, গঠিত হয় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এসময় অনেক কবি এবং আবৃত্তিকারকে জেল জুলুম খাটতে হয়। হুলিয়া চলে আসে। অনেক কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এসময় কবিতা এবং আবৃত্তি একই সাথে কাজ করেছে। নব্বইয়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে প্রেমের কবিতাও প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গেল এক সময়। আমরা খুব রোমান্টিক কবিতাকেও মানুষের দাবিদাওয়া হিসেবেই তুলে ধরলাম। তখন নিষিদ্ধ ছিল আমাদের কবিতা পড়া। আমরা কবিতা পড়তে গেলেই পুলিশ ধাওয়া করতো। । আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হত। সেই প্রেক্ষাপটেই আমার জন্ম। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতেই আবৃত্তি করা, আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই।
জেমস আনজুস: নব্বইয়ের আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসক এরশাদ বিদায় হল।
শিমুল মুস্তাফা : তবে নব্বইয়ের পর আমার মনে হয়েছে একাত্তরে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা স্বপ্নই রয়ে গেছে। অনেকে বলে একানব্বইয়ে আমাদের দেশে গনতন্ত্র এসেছে, আমার কাছে তা গনতন্ত্র মনে হয় না। গনতন্ত্র সংজ্ঞাই আমাদের দেশের মানুষ জানে না। খুবই কম সময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। এত অল্প সময়ে আমরা আসলে বুঝতে পারিনি, এই বিজয় যদি নয় বছরে হত তাহলে এর মূল্য আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশন যুদ্ধ চললে আমরা এর মূল্যটা বুঝতাম। বায়ান্ন, একাত্তর বা নব্বইয়ে সমর্থন দিয়েছিল অনেকে, কিন্তু বিসর্জন দেয়নি। স্বৈরশাসকের সময়ে আমাদের মত অনেক শিল্পী রাজাকারের ভূমিকা পালন করেছে। আসলে অতীত আমরা খুব সহজে ভুলে যেতে পারি, নাহলে হয়ত আমরা বাঁচতে পারতাম না। একদিক দিয়ে এটা যেমন ভাল, আবার এটাই হচ্ছে সবচে খারাপ দিক।
একানব্বইয়ের পরে আবৃত্তি আস্তে আস্তে সংগঠিত হল। প্রেমের কবিতা যেভাবে প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে তা আবার প্রেমের কবিতা হয়ে উঠল। প্রতিবাদের কবিতাগুলো আমরা ধীরে ধীরে পড়তে ভুলে গেলাম। আমরা আমাদের ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদ- বাহান্ন, একাত্তর, নব্বই এই আন্দোলন করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নব্বইয়ের পর যখন আমরা আলোর দিশা দেখলাম, তখন আমরা হুরমুর করে সেই দিশার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। আমাদের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য আমরা নেমে পড়লাম। অনেকে ভেবেছে আমাদের আর এভাবে চললে হবে না। তখন অনেকেই আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল হয়ে উঠল। এর ফলে আমরা শিল্পীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করতে শুরু করল , আরেকটি আমরা আগের মতই রয়ে গেলাম।
জেমস আনজুস: শিল্পীদের কি রাজনৈতিক পরিচয় থাকাটা জরুরি?
শিমুল মুস্তাফা : শিল্পীর রাজনৈতিক আদর্শ থাকাটা জরুরি, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের ভেতর অবস্থান করে কাজ করাটা আমি সমর্থন করি না। আমাকে যদি বলা হয় হাতের দশটা আঙল কেটে ফেলা হবে, আমি কিন্তু পায়ের আঙল দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই আমার অবস্থান জানাব। কিন্তু টেলিভিশন পর্দার সামনে অনেক দেশ প্রেমিক দেখা যায়, তারা কিন্তু ঠিকই দৌড়ে পালাবে। কে সরকার হল এটা আমি দেখি না , আমি দেখি কে দেশকে ভালবাসার কথা বলে, কে আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে। আমার জীবনে আমি কোন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে কবিতা পড়িনি। আমার পয়ত্রিশ বছর আবৃত্তি জীবনে আমি কোন দিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমন্ত্রন পাইনি। তাতে কি হয়েছে?
জেমস আনজুস: আমাদের সংস্কৃতি চর্চার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
শিমুল মুস্তাফা : আমরা পাতা বাহার দিয়ে বাগান ভরে ফেলছি কিন্তু গোলাপ ফোটাতে পারছি না। আমি একটি জিনিস মনে করি যে একটি জিনিসের বিন্দু যদি সরে যায়, বৃত্তও সরে যায়। আমাদের বিন্দু গুলো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। আমাদের শেকড় থেকে বিন্দু সরে যাচ্ছে। আমাকে অনেকে বলে আপনি এখানে যান না কেন, ওখানে যান না কেন? আসলে শিল্পীকে লোক দেখানোর জন্য শিল্প চর্চা করলে হবে না। টেলিভিশনের পর্দা বা বিশেষ জায়গার প্রয়োজন হয়না শিল্পী হওয়া জন্য। একজন বলেছেন, তুমি যদি সুরেলা কন্ঠে গান গাও তাহলে পৃথিবীর যে প্রান্তে বসেই গাও না কেন, কেও না কেও তা ঠিকই শুনছে। আমি যদি অজপাড়াগায়ে বসেও যদি দেশের জন্য কাজ করি, কোন শিল্পের জন্য কাজ করি কোন একদিন সেখান থেকেই আলো জ্বলে উঠবে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, আপনাকে আগের মত দেখিনা কেন? আমি একটিই উত্তর দেই, আমি আগের জায়গাতেই আছি, বরং আপনারাই আগের জায়গা থেকে সরে গিয়েছেন। তাই আমাকে দেখতে পান না।
আর মূল্যবোধের জায়গাটায় আমরা খুবই দূর্বল। এখনকার সরকার ব্যবস্থায় আমার প্রতিবাদের জায়গা হল, আমরা খুব অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি, এতে করে আমাদের মূল্যবোধের জায়গাটা খুব কমে যাচ্ছে। দশ-পনের বছর ধরে যা দেখছি, এ প্রজন্ম কিন্তু অনেক মেধাসম্পন্ন, কিন্তু এ প্রজন্মকে নৈতিক জায়গাটা শেখানো হচ্ছে না। এজন্য আমি বলি, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে, মানসিক প্রবৃদ্ধিটা বাড়ানো উচিত। আমার কষ্ট করতে আপত্তি নেই । একবেলা কম খাব, কিন্তু আমাদের নৈতিক বোধটা যদি বাড়তো আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসার জায়গাটা যদি কমতো তবে খুব ভাল হত।
জেমস আনজুস: শুধুমাত্র ঢাকা শহরের কথাই যদি বলি, শিল্পচর্চা বা শিল্প প্রদর্শনের তেমন একটা জায়গা কিন্তু নেই।
শিমুল মুস্তাফা : বাংলাদেশ এমন একটি দেশ- ষড় ঋতুর দেশ, শিল্পের দেশ। আমাদের মন এমনিতেই শিল্পের দিকে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্পচর্চা করার মত জায়গা তেমন একটা নেই। ঢাকার মত একটি সিটিতে কয়টি মঞ্চ আছে? জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী ছাড়া তেমন ভাল কোন অডিটরিয়াম নেই। জাদুঘর অডিটরিয়মের যে ভাড়া তা সবার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। উত্তরার মত জায়গাতে অনুষ্ঠান করার মত কোন অডিটরিয়াম নেই । মিরপুরে নেই। যাত্রাবাড়িতে নেই। এখানকার মানুষগুলো কোথায় অনুষ্ঠান করবে? কোটি মানুষের ঢাকা শহরে শিল্পকলা আর জাদুঘর অডিটরিয়াম দিয়ে কি সব শিল্পমন তুষ্ট করা যাবে? এই সমস্যা গুলো সমাধান করা যায় খুব সহজে। শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রয়োজন। শুধু ইচ্ছা। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এদেশের শিল্পপতিরাও এদিকে নজর দেন না।
জেমস মুস্তাফা: আবৃত্তির সংগঠন গুলো যেভাবে কাজ করছে, আবৃত্তি শিল্পী কি আমরা সেভাবে পাচ্ছি ?
শিমুল মোস্তফা : ওটার জন্য আমরা কিছু দায়ী, আর আমাদের মন মানসিকতা অনেকখানি দায়ী। একটি জাতীর পরিচয় বহন করে তার শিল্পকলা। বাংলাদেশকে আমরা চিনব এদেশের শিল্পকলা দিয়ে। ভারতে যে বাণিজ্যিক শিল্পকলা গুলো হচ্ছে- চলচ্চিত্রে, গানে আমরা কিন্তু ওটা দ্বারা মোহিত হচ্ছি। কিন্তু ভারতে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে একজন বানিজ্যিক শিল্পীর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হয়। ভারতে একটি গানের লিরিক জাবেদ আকতার লিখলে পাঁচ লক্ষ রুপিস পায়। বাংলাদেশে একটি গানের লিরিক লিখলে পাঁচশত টাকা পায়। আমাদের দেশে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তার চেয়ে দশগুন বেশি মূল্যায়ন করা হয় আধুনিক একজন ড্যান্সারকে। আজকে আমি কবিতা লিখলে আমাকে যদি দুইশত টাকা সম্মানী দেওয়া হয়, আর কবিতার অর্ধেক শ্রম দিয়ে আমি যদি একটি টেলি নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করি আমাকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ফলে এ প্রজন্ম কবিতা লিখবে না নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখবে। আমি কবিতা পড়লে আমাকে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে বিদায় করা হয়, আর একজন ড্যান্সার মঞ্চে উঠলে তাকে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোও তাই। আমাদেরকে এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন করা হয়, আর একজন সংগীত শিল্পী আসলে ষাট-সত্তর হাজার টাকা। আমাদের শিল্পবোধের কারনেই হয়তো ভাল আবৃত্তি শিল্পী বা একজন ভাল কবি আমরা পাই না। প্রজ্ঞা লাবনী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী। একটি টিভি চ্যানেলে তিন ঘন্টা সরাসরি অনুষ্ঠান করার পর তার হাতে একহাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, শিল্পীকে টাকা না দাও, কিন্তু অসম্মান কোরো না। সেই চ্যানেলে পাঁচ বছর ধরে আমাকে ডাকে না। আমি প্রতিবাদ করব, আরেক জন করবে, তৃতীয়জন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে টেলিভিশনে আবৃত্তি করবে। কারণ আমাদের লোভ লালসাটা অনেক বেশি। কেও কেও অর্থের জন্য লালসা দেখায়, কেও কেও অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়। এদের দলে তো আমরা নই।
জেমস আনজুস: রাষ্ট্রিয় ভাবে আবৃত্তির মূল্যায়ন কি সেভাবে হচ্ছে, গান নাচ বা চলচ্চিত্র শিল্পের বিবেচনায়?
শিমুল মুস্তাফা : আমরা যাদের দ্বারা ভাষা পেয়েছি- শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি কয়টা ফুল দিয়ে সব দায় মিটিয়ে দেই। বিশ্বের বুকে যারা এদেশের জন্য সম্মান এনে দিয়েছে তাদেরকেই বা কতটুকু দিয়েছি? দস্যু বনহুরের লেখক রুমেনা আরফাস, যার বই ট্রাকে করে করে বিক্রি হয়েছে। সেই নারী রাষ্ট্রিয় সম্মান তো দূরের কথা, ফুল দিয়েও তাকে সম্মান জানানো হয় নি। মরে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমরা হঠাৎ করে মনে করলাম শাহ আব্দুল করিমের কথা। তারপর তাকে নিয়ে কাজ কাজ শুরু করলাম। বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে একটি জন্ম বাষির্কী পালক করা হয় না। তার নামে একটি প্রতিষ্ঠান কেন, রাস্তাও হয়নি। অথচ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জামানত বাতিল হয়েছিল এমন একজনের নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া। তাকে আমরা নূন্যতম মূল্যায়ন করতে পারিনি। আবৃত্তির ক্ষেত্রে আশা করাটা তাই মানায় না।
জেমস আনজুস: পেশা হিসেবে আবৃত্তি শিল্পের ভবিষ্যৎ কি?
শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি পেশা হিসেবে দাড়াবে- এমটা আমি চাইনা। শিল্প যখন পেশা হয়ে যায় তখন শিল্পত্ব হানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে একজন ক্লাসিক্যাল শিল্প আছে পন্ডিত গোলাম মোস্তফা। সংগীতটা তার প্রার্থনার মত। টেলিভিশনের সামনে আসাটা তার জন্য জরুরি না। প্রার্থনাটা তার জন্য জরুরি। লালন যখন গান করেছেন, তিনি কিন্তু এই চিন্তা করে গান করেন নি যে পরবর্তীতে আরো অনেকে তার গান গাইবে। তিনি তার আত্ম তৃপ্তির জন্য গেয়েছেন। সেরকম আবৃত্তি আসলে আত্মতৃপ্তির জন্যই করা উচিত।
জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি ভাল লাগাটা কিভাবে তৈরি হল?
শিমুল মুস্তাফা : এটা তো কোন আয়োজন করে হয় না। আস্তে আস্তে বিষয়টি ঘটে যায়। আমার পারিবারিক বন্ধনই ছিল শিল্পমনা। আমার মা বাবা দুজনেই চারুকলার ছিলেন। তাই পরিবারেই একটি শিল্পের আবহ ছিল ।
জেমস আনজুস: কবিতা ও আবৃত্তি- শিল্পের দুটি মাধ্যমকে কিভাবে বিবেচনা করবেন।
শিমুল মুস্তাফা : কবিতা এবং আবৃত্তির সম্পর্ক অনেকটা মা-মাসির মত। আমি এটাই বলি কবিতা জন্ম দেন কবি, তিনি মা। আর কিন্তু আবৃত্তিকাররা কবিতার মাসি অন্তত। জনক না হলেও স্নেহের জায়গাটা, প্রেমের জায়গাটা, আন্তরিকতার জায়গাটা, লালনের জায়গাটা একটা আবৃত্তিকারের কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। কবিতা হচ্ছে বোধের জায়গাটা তৈরি, মানুষকে উপলব্ধি করার জায়গাটা। আমি কবিতাকে এভাবেই ধারণ করি। কবিতা ভালবেসেই পড়ি। আমি যা পড়ি তা বিশ্বাস করি। যেমন ভাল লাগল একটি কবিতা , কিন্তু আমার আদর্শের সাথে মেলেনা , আমি সে কবিতা পড়ি না। আবৃত্তি কন্ঠের শিল্প নয়, মস্তিষ্কের শিল্প। কন্ঠ হচ্ছে একটি সাউন্ড বক্সের মত। মস্তিষ্ক যদি পরিশিলীত না হয়, সাউন্ড বক্স নিজে নিজে আর কি রকম বাজতে পারে? আমার মস্তিষ্কে যে বোধ এবং দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে, সেটাই আমি কন্ঠ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি।
জেমস আনজুস: বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার পটভূমি নিয়ে যদি কিছু বলেন..
শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি চর্চার ব্যাপারটা আসলে স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়। কিন্তু আমি বলব আবৃত্তির মূল বহিঃপ্রকাশ গোলাম মোস্তফা, ইকবাল বাহার চৌধুরী, হাসান ইমাম এদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয়। এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে আবৃত্তি সেই অর্থে ভূমিকা না রাখলেও মধ্য সত্তরের দিকে কাজী আরিফ, জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় সাথে প্রবীন যে আবৃত্তি শিল্পীদের কথা বললাম এরা মিলে আবার আবৃত্তি চর্চা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সত্তরের দশকের রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটের কারণে শিল্প চর্চায়ও একটি ধ্বস নেমে আসে। কারণ আমরা দেখেছি দেশের ক্রান্তিকালে শিল্পীরা তাদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী করে ফেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য পচাত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত শিল্পকলার প্রত্যেকটি মাধ্যম সেই ভাবে জেগে উঠতে পারেনি। অনেকটাই আস্থাহীন, হতাশায় পড়ে গিয়েছিল শিল্পীরা। আমাদের বিগত দু’শত বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আমরা যেভাবে রুখে দাড়িয়েছি, কিন্তু এই পাঁচ বছর আমাদের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন মিডিয়া যে ভাবে কাজ করছে, তখন তো এত মিডিয়া ছিল না। আর যেগুলো ছিল সেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করেছে। ফলে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল।
জেমস আনজুস: নব্বইয়ের গন আন্দোলনে আবৃত্তির তো বিরাট ভূমিকা ছিল...
শিমুল মুস্তাফা : একাশির পর আবার নতুন করে প্রেরণা, অনেক সাহস, নতুন উদ্দিপনা, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে শিল্পকলায় আমাদের অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এবংএরই ধারাবাহিকতায় খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে আমাদের থিয়েটার এবং সাথে সাথে আবৃত্তি। তখন সংগীত যতটা না সক্রিয় হয়ে ওঠে, থিয়েটার এবং আবৃত্তি অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। সেই সময় পথনাটক কর্মীরা, মঞ্চ নাটক কর্মীরা রাজপথে ছিলে, তবে নেতৃত্বে ছিল আবৃত্তি শিল্পীরা। আবৃত্তিতে সে সময় যে পরিবর্তন আসে, তা হল আমাদেরকে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী যে শৃঙ্খলিত করে রাখার পায়তারা ছিল তার বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলি। এরই সাথে সাথে কবিরাও সোচ্চার হয়ে উঠে। স্বৈরাচারি সরকার হটাতে তারাও উদগ্রিব হয়ে ওঠে। তারই ফলশ্রুতিতে মধ্য আশিতে তৈরি হয় কবিতা পরিষদ। এবং শুরুতেই তখন বলা হয়েছিল যে, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এই কথা প্রথম কবিরাই প্রকাশ করে। তার বছর দুয়ের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় আবৃত্তি উৎসব, গঠিত হয় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এসময় অনেক কবি এবং আবৃত্তিকারকে জেল জুলুম খাটতে হয়। হুলিয়া চলে আসে। অনেক কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এসময় কবিতা এবং আবৃত্তি একই সাথে কাজ করেছে। নব্বইয়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে প্রেমের কবিতাও প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গেল এক সময়। আমরা খুব রোমান্টিক কবিতাকেও মানুষের দাবিদাওয়া হিসেবেই তুলে ধরলাম। তখন নিষিদ্ধ ছিল আমাদের কবিতা পড়া। আমরা কবিতা পড়তে গেলেই পুলিশ ধাওয়া করতো। । আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হত। সেই প্রেক্ষাপটেই আমার জন্ম। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতেই আবৃত্তি করা, আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই।
জেমস আনজুস: নব্বইয়ের আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসক এরশাদ বিদায় হল।
শিমুল মুস্তাফা : তবে নব্বইয়ের পর আমার মনে হয়েছে একাত্তরে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা স্বপ্নই রয়ে গেছে। অনেকে বলে একানব্বইয়ে আমাদের দেশে গনতন্ত্র এসেছে, আমার কাছে তা গনতন্ত্র মনে হয় না। গনতন্ত্র সংজ্ঞাই আমাদের দেশের মানুষ জানে না। খুবই কম সময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। এত অল্প সময়ে আমরা আসলে বুঝতে পারিনি, এই বিজয় যদি নয় বছরে হত তাহলে এর মূল্য আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশন যুদ্ধ চললে আমরা এর মূল্যটা বুঝতাম। বায়ান্ন, একাত্তর বা নব্বইয়ে সমর্থন দিয়েছিল অনেকে, কিন্তু বিসর্জন দেয়নি। স্বৈরশাসকের সময়ে আমাদের মত অনেক শিল্পী রাজাকারের ভূমিকা পালন করেছে। আসলে অতীত আমরা খুব সহজে ভুলে যেতে পারি, নাহলে হয়ত আমরা বাঁচতে পারতাম না। একদিক দিয়ে এটা যেমন ভাল, আবার এটাই হচ্ছে সবচে খারাপ দিক।
একানব্বইয়ের পরে আবৃত্তি আস্তে আস্তে সংগঠিত হল। প্রেমের কবিতা যেভাবে প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে তা আবার প্রেমের কবিতা হয়ে উঠল। প্রতিবাদের কবিতাগুলো আমরা ধীরে ধীরে পড়তে ভুলে গেলাম। আমরা আমাদের ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদ- বাহান্ন, একাত্তর, নব্বই এই আন্দোলন করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নব্বইয়ের পর যখন আমরা আলোর দিশা দেখলাম, তখন আমরা হুরমুর করে সেই দিশার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। আমাদের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য আমরা নেমে পড়লাম। অনেকে ভেবেছে আমাদের আর এভাবে চললে হবে না। তখন অনেকেই আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল হয়ে উঠল। এর ফলে আমরা শিল্পীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করতে শুরু করল , আরেকটি আমরা আগের মতই রয়ে গেলাম।
![]() |
শিমুল মুস্তাফা’র সাথে এই ব্লগের লেখক |
জেমস আনজুস: শিল্পীদের কি রাজনৈতিক পরিচয় থাকাটা জরুরি?
শিমুল মুস্তাফা : শিল্পীর রাজনৈতিক আদর্শ থাকাটা জরুরি, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের ভেতর অবস্থান করে কাজ করাটা আমি সমর্থন করি না। আমাকে যদি বলা হয় হাতের দশটা আঙল কেটে ফেলা হবে, আমি কিন্তু পায়ের আঙল দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই আমার অবস্থান জানাব। কিন্তু টেলিভিশন পর্দার সামনে অনেক দেশ প্রেমিক দেখা যায়, তারা কিন্তু ঠিকই দৌড়ে পালাবে। কে সরকার হল এটা আমি দেখি না , আমি দেখি কে দেশকে ভালবাসার কথা বলে, কে আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে। আমার জীবনে আমি কোন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে কবিতা পড়িনি। আমার পয়ত্রিশ বছর আবৃত্তি জীবনে আমি কোন দিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমন্ত্রন পাইনি। তাতে কি হয়েছে?
জেমস আনজুস: আমাদের সংস্কৃতি চর্চার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
শিমুল মুস্তাফা : আমরা পাতা বাহার দিয়ে বাগান ভরে ফেলছি কিন্তু গোলাপ ফোটাতে পারছি না। আমি একটি জিনিস মনে করি যে একটি জিনিসের বিন্দু যদি সরে যায়, বৃত্তও সরে যায়। আমাদের বিন্দু গুলো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। আমাদের শেকড় থেকে বিন্দু সরে যাচ্ছে। আমাকে অনেকে বলে আপনি এখানে যান না কেন, ওখানে যান না কেন? আসলে শিল্পীকে লোক দেখানোর জন্য শিল্প চর্চা করলে হবে না। টেলিভিশনের পর্দা বা বিশেষ জায়গার প্রয়োজন হয়না শিল্পী হওয়া জন্য। একজন বলেছেন, তুমি যদি সুরেলা কন্ঠে গান গাও তাহলে পৃথিবীর যে প্রান্তে বসেই গাও না কেন, কেও না কেও তা ঠিকই শুনছে। আমি যদি অজপাড়াগায়ে বসেও যদি দেশের জন্য কাজ করি, কোন শিল্পের জন্য কাজ করি কোন একদিন সেখান থেকেই আলো জ্বলে উঠবে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, আপনাকে আগের মত দেখিনা কেন? আমি একটিই উত্তর দেই, আমি আগের জায়গাতেই আছি, বরং আপনারাই আগের জায়গা থেকে সরে গিয়েছেন। তাই আমাকে দেখতে পান না।
আর মূল্যবোধের জায়গাটায় আমরা খুবই দূর্বল। এখনকার সরকার ব্যবস্থায় আমার প্রতিবাদের জায়গা হল, আমরা খুব অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি, এতে করে আমাদের মূল্যবোধের জায়গাটা খুব কমে যাচ্ছে। দশ-পনের বছর ধরে যা দেখছি, এ প্রজন্ম কিন্তু অনেক মেধাসম্পন্ন, কিন্তু এ প্রজন্মকে নৈতিক জায়গাটা শেখানো হচ্ছে না। এজন্য আমি বলি, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে, মানসিক প্রবৃদ্ধিটা বাড়ানো উচিত। আমার কষ্ট করতে আপত্তি নেই । একবেলা কম খাব, কিন্তু আমাদের নৈতিক বোধটা যদি বাড়তো আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসার জায়গাটা যদি কমতো তবে খুব ভাল হত।
জেমস আনজুস: শুধুমাত্র ঢাকা শহরের কথাই যদি বলি, শিল্পচর্চা বা শিল্প প্রদর্শনের তেমন একটা জায়গা কিন্তু নেই।
শিমুল মুস্তাফা : বাংলাদেশ এমন একটি দেশ- ষড় ঋতুর দেশ, শিল্পের দেশ। আমাদের মন এমনিতেই শিল্পের দিকে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্পচর্চা করার মত জায়গা তেমন একটা নেই। ঢাকার মত একটি সিটিতে কয়টি মঞ্চ আছে? জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী ছাড়া তেমন ভাল কোন অডিটরিয়াম নেই। জাদুঘর অডিটরিয়মের যে ভাড়া তা সবার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। উত্তরার মত জায়গাতে অনুষ্ঠান করার মত কোন অডিটরিয়াম নেই । মিরপুরে নেই। যাত্রাবাড়িতে নেই। এখানকার মানুষগুলো কোথায় অনুষ্ঠান করবে? কোটি মানুষের ঢাকা শহরে শিল্পকলা আর জাদুঘর অডিটরিয়াম দিয়ে কি সব শিল্পমন তুষ্ট করা যাবে? এই সমস্যা গুলো সমাধান করা যায় খুব সহজে। শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রয়োজন। শুধু ইচ্ছা। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এদেশের শিল্পপতিরাও এদিকে নজর দেন না।
জেমস মুস্তাফা: আবৃত্তির সংগঠন গুলো যেভাবে কাজ করছে, আবৃত্তি শিল্পী কি আমরা সেভাবে পাচ্ছি ?
শিমুল মোস্তফা : ওটার জন্য আমরা কিছু দায়ী, আর আমাদের মন মানসিকতা অনেকখানি দায়ী। একটি জাতীর পরিচয় বহন করে তার শিল্পকলা। বাংলাদেশকে আমরা চিনব এদেশের শিল্পকলা দিয়ে। ভারতে যে বাণিজ্যিক শিল্পকলা গুলো হচ্ছে- চলচ্চিত্রে, গানে আমরা কিন্তু ওটা দ্বারা মোহিত হচ্ছি। কিন্তু ভারতে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে একজন বানিজ্যিক শিল্পীর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হয়। ভারতে একটি গানের লিরিক জাবেদ আকতার লিখলে পাঁচ লক্ষ রুপিস পায়। বাংলাদেশে একটি গানের লিরিক লিখলে পাঁচশত টাকা পায়। আমাদের দেশে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তার চেয়ে দশগুন বেশি মূল্যায়ন করা হয় আধুনিক একজন ড্যান্সারকে। আজকে আমি কবিতা লিখলে আমাকে যদি দুইশত টাকা সম্মানী দেওয়া হয়, আর কবিতার অর্ধেক শ্রম দিয়ে আমি যদি একটি টেলি নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করি আমাকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ফলে এ প্রজন্ম কবিতা লিখবে না নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখবে। আমি কবিতা পড়লে আমাকে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে বিদায় করা হয়, আর একজন ড্যান্সার মঞ্চে উঠলে তাকে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোও তাই। আমাদেরকে এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন করা হয়, আর একজন সংগীত শিল্পী আসলে ষাট-সত্তর হাজার টাকা। আমাদের শিল্পবোধের কারনেই হয়তো ভাল আবৃত্তি শিল্পী বা একজন ভাল কবি আমরা পাই না। প্রজ্ঞা লাবনী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী। একটি টিভি চ্যানেলে তিন ঘন্টা সরাসরি অনুষ্ঠান করার পর তার হাতে একহাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, শিল্পীকে টাকা না দাও, কিন্তু অসম্মান কোরো না। সেই চ্যানেলে পাঁচ বছর ধরে আমাকে ডাকে না। আমি প্রতিবাদ করব, আরেক জন করবে, তৃতীয়জন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে টেলিভিশনে আবৃত্তি করবে। কারণ আমাদের লোভ লালসাটা অনেক বেশি। কেও কেও অর্থের জন্য লালসা দেখায়, কেও কেও অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়। এদের দলে তো আমরা নই।
জেমস আনজুস: রাষ্ট্রিয় ভাবে আবৃত্তির মূল্যায়ন কি সেভাবে হচ্ছে, গান নাচ বা চলচ্চিত্র শিল্পের বিবেচনায়?
শিমুল মুস্তাফা : আমরা যাদের দ্বারা ভাষা পেয়েছি- শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি কয়টা ফুল দিয়ে সব দায় মিটিয়ে দেই। বিশ্বের বুকে যারা এদেশের জন্য সম্মান এনে দিয়েছে তাদেরকেই বা কতটুকু দিয়েছি? দস্যু বনহুরের লেখক রুমেনা আরফাস, যার বই ট্রাকে করে করে বিক্রি হয়েছে। সেই নারী রাষ্ট্রিয় সম্মান তো দূরের কথা, ফুল দিয়েও তাকে সম্মান জানানো হয় নি। মরে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমরা হঠাৎ করে মনে করলাম শাহ আব্দুল করিমের কথা। তারপর তাকে নিয়ে কাজ কাজ শুরু করলাম। বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে একটি জন্ম বাষির্কী পালক করা হয় না। তার নামে একটি প্রতিষ্ঠান কেন, রাস্তাও হয়নি। অথচ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জামানত বাতিল হয়েছিল এমন একজনের নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া। তাকে আমরা নূন্যতম মূল্যায়ন করতে পারিনি। আবৃত্তির ক্ষেত্রে আশা করাটা তাই মানায় না।
জেমস আনজুস: পেশা হিসেবে আবৃত্তি শিল্পের ভবিষ্যৎ কি?
শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি পেশা হিসেবে দাড়াবে- এমটা আমি চাইনা। শিল্প যখন পেশা হয়ে যায় তখন শিল্পত্ব হানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে একজন ক্লাসিক্যাল শিল্প আছে পন্ডিত গোলাম মোস্তফা। সংগীতটা তার প্রার্থনার মত। টেলিভিশনের সামনে আসাটা তার জন্য জরুরি না। প্রার্থনাটা তার জন্য জরুরি। লালন যখন গান করেছেন, তিনি কিন্তু এই চিন্তা করে গান করেন নি যে পরবর্তীতে আরো অনেকে তার গান গাইবে। তিনি তার আত্ম তৃপ্তির জন্য গেয়েছেন। সেরকম আবৃত্তি আসলে আত্মতৃপ্তির জন্যই করা উচিত।
অসামান্য একটা পোস্ট। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকেও।
উত্তরমুছুন888casino - Best Air Jordan Sportsbook Promos, Bonuses
উত্তরমুছুন888 casino promo air jordan 18 retro varsity red for sale codes & bestest air jordan 18 retro racer blue deals for December 2021. Find the latest air sportsbook promo 스포츠 토토 사이트 codes at top online get air jordan 18 retro men red casinos in website to buy air jordan 18 retro men red Jordan.