বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ এর সাক্ষাৎকার- An interview of famous recitation artist Hasan Arif

শিল্পের লড়াইটা সংখ্যায় নয়, শিল্পের লড়াইটা সৃজনে:  হাসান আরিফ





খুবই ধীর স্থির স্বভাবের মানুষ। শিল্পের সাথে সংস্কৃতি এবং রাজনীতির যে সম্পর্ক, এই মেলবন্ধনে রয়েছে তার নিজস্ব্য দর্শন। মধ্য আশির দশক থেকে আবৃত্তি করছেন। বেশকিছু অ্যালবামও বের হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তিনি নির্ভীক যোদ্ধা । তার মায়ের নাম রওশন আরা। বাবা প্রয়াত আবুল ফজল মো. মফিজুল হক। কুমিল্লায় নানা বাড়িতে ৮ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহন করেন এই গুণী আবৃত্তি শিল্পী। তার সাথে কথা বলে সাক্ষাৎকারটি তৈরি করেছেন জেমস আনজুস ।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি ভাল লাগাটা কিভাবে তৈরি হল?

হাসান আরিফ: ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের পরিবারে মা-বাবা, চাচা, খালা অনেকে কবিতা পড়তেন। সেটা ঠিক আমি আবৃত্তি বলব না। তাদের কবিতা ভাল লাগত, তাই তারা সেই কবিতাগুলো আমাদের পড়ে শোনাতেন। এবং এই কবিতাগুলো  শুনে আমার মনে হল কবিতা বলার বিষয়। অর্থাৎ কবিতাটা ভাল লাগে তাই পড়া। এখানে আবৃত্তির কোন বিষয় ছিল না। যখন আমি একটু বড় হলাম, কৈশর সময় তখন। আমার এক খালাত ভাই ছিল। তিনিও খুব কবিতা বলতেন। তার অনেক কবিতা মুখস্থ ছিল। কবিতা মুখস্থ করে রাখার ব্যাপারটা তার কাছ থেকেই শিখেছি। আর আমার মায়ের কাছ থেকে ভাল বই পড়ার আগ্রহটা তৈরি হয়েছে । কারণ আমি যখন আমার নাম লিখতে শিখলাম, তখন দেখলাম আমার নাম দিয়ে মা অনেক বই কিনেছেন। সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা এধরনের  বইগুলো কেনা হয়েছে আমার অথবা আমার ভাইয়েদের  নাম দিয়ে। তার সংগ্রহে অনেক বই ছিল। এই ভাবেই কবিতা ভালা লাগা শুরু হল। আমারও মনে হল কবিতা মনে ধরে রাখি এবং অন্যদের শোনাই। তখনও কিন্তু আমি আবৃত্তি বিষয়টা জানি না। সব্যসাচী, গোলাম মোস্তফা  তাদের আবৃত্তি শুনেছি। তবে আবৃত্তি আলাদা করে বুঝলাম যে পঁচাশি সালে কামরুল হাসান মঞ্জু , তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটা কর্মশালা করলেন। তার কর্মশালা আমার আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রথম যখন আমাদের স্বাক্ষাৎকার নেন, সেদিন তার সাথে আমার আড্ডা জমে গিয়েছিল। কারণ আমার তো কবিতা জানা ছিল। আমি তার কাছে ঋণী একারণে যে, কোথাও বসে কিছু শেখা এধরনের মানসিকতা আমার ছিল না । খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। কর্মশালায় আমার মনে হল কিছু কিছু ছোট ছোট বিষয় আমি জেনে নিলেই পারি।  আমার তো কবিতা জানাই আছে। সেই কবিতাগুলোকে নতুন করে বলা। এ এক নতুন খেলা।


জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি কখন থেকে নিবেদিত হলেন?

হাসান আরিফ: ১৯৮৩ সালে স্বরিত আবৃত্তিচক্র নামে একটি সংগঠন করা হয়। এর আগে তৈরি হয় আবৃত্তি সংসদ। এটা ছিল প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে তৈরি সংগঠন। সেই বিবেচনায় স্বরিত আবৃত্তি সংঘকেই সংগঠন বলা যায়, বর্তমানে আবৃত্তি সংগঠন বলতে আমরা যা বুঝি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আশির দশকের গোড়ার দিকে শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বাচনিক  উৎকর্ষের একটি কর্মশালা করেন। সেখানে যারা যার অংশগ্রহন করেছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাবলেন একটা দল করবেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু, গীতি আরা নাসরিন, লায়লা আফরোজ, খ্রীষ্টিনা রোজারিও, আনিসুজ্জামান। তাদের এই দল করবার ভাবনাটাই ছিল আবৃত্তির সাংগঠনিক ভিত্তি। সেসময় ডাকসুতে লিয়াকত আলী লাকী সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। ডাকসুরও একটি আবৃত্তি দল করা হয়। তখন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ডাকসুর আবৃত্তিদল বৃন্দ আবৃত্তি করে  স্বাধীনতা দিবসে। সেই আবৃত্তি একটা দরজা খুলে দিয়েছিল। এরপরই ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অনেকগুলো দল তৈরি হয়ে গেল। আটাশিতে এসে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠন করা হয়। সংগঠনভিত্তিক আবৃত্তি চর্চার প্রায় শুরুর দিকে আমি আবৃত্তির সাথে যুক্ত হই।

জেমস আনজুস: স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলনে আবৃত্তি শিল্পীরা তো সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল।

হাসান আরিফ: পচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে পরবর্তী পাচ বছর শিল্প-সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত ছিল। গণজাগরণ বা গণ ধিক্কার কিন্তু হয়নি। মানুষ হতাশ হয়েছিল, অবাক হয়ে ছিল, বিস্মৃত হয়েছিল। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে আন্দোলন সংগঠিত করেছিল, পচাত্তরে তারা ব্যর্থ হল। তারপর একের পর এক সামরিক সরকার। জিয়াউর রহমানের পর এরশাদ। তখন কিন্তু  ছাত্ররা বুঝে গেল একে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেদিক থেকে বলি আশির দশকের গোড়ায় প্রথম সংগঠিত হল গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। গ্রুপ থিয়েটার সংঘবদ্ধ হওয়ার পর তারা আমাদের দীর্ঘ পথ দেখিয়েছে। এর পর হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আওতায় আমাদের আবৃত্তি সংগঠনগুলো কাজ করে যাচ্ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে আবৃত্তি উজ্জ্বল ছিল কারণ যারা আবৃত্তি করত- যদি সুকান্তের ভাষাই বলি, তাদের গড় বয়স ছিল আঠারো। এই যে আঠারো, উনিশ, কুড়ি- এই বয়স কিন্তু বাধ না মানা বয়স। দেশপ্রেমের কাছে নিজেকে বলি দেওয়ার বয়স। তীক্ষ্ম, তীব্র এক লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাওয়ার বয়স। পুরো নব্বইয়ের  স্বৈারাচার বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এই সমন্বিত আবৃত্তি শিল্পীরা একধরনের প্রাণসঞ্চার তৈরি করল। কারণ অনুজপ্রতীমরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, শক্তি নিয়ে দাড়ায়; তখন অগ্রজ যারা তার যদি প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার শংকায় থাকলেও, সেটা আর থাকে না। অনুজপ্রতীমরা যখন একটা ধাক্কা দেয়, সেই ধাক্কাটা বড় করে হয়। দীর্ঘ দিন যারা পথ চলছে তাদের অফুরন্ত প্রেরণার মধ্যে ঠেলে দেয়। এবং আমি বোধ করি আবৃত্তি শিল্পীরা তা-ই ঘটিয়ে ছিলেন।




জেমস আনজুস: সেই সময়ের কবিতা নিয়ে আপনার কাছে কিছু শুনতে চাই।

হাসান আরিফ: কখনো কখনো আমরা কিন্তু সময়কে ঘিরে, বিষয়কে ঘিরে আমরা কিন্তু কথা শুনতে চাই। তখন কবিরা প্রতিদিনের ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখছেন। যা ঘটছে তাই নিয়ে কবিতা লিখছেন। আর আবৃত্তি শিল্পীরা তা আবৃত্তি করছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ সংগঠিত হয়েছিল আশির দশকে। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের পূর্বেই জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়। সব মিলিয়ে যদি এভাবে বলি, যে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং তার-ই ধারাবাহিকতায় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।  সেই সময় আবৃত্তি শিল্পীরা অসংখ্য কবিতা পেয়েছিল। প্রতিদিন তাজা কবিতা পেয়েছিল। সময়ের সাহসী মানুষদের মধ্যে যাকে সবার উজ্জ্বল বলতে হয়, তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তখন তিনিও যুবক একজন। তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, ‘দাড়াও , নিজেকে প্রশ্ন কর কোন দিকে যাবে? ’  তিনি আমার আমার হাতে তুলে দিয়েছেন ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনা শকুন’ এই যে কবিতায় সরাসরি কথা হচ্ছে, এই কথা যখন মানুষকে বলছি তখন তো আবেদনটা তীব্র হয়। ওই সময় কবিতা তৈরি হচ্ছে হেলাল হাফিজ বলছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাব শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার মিছিলে যারা তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ একই সময় নির্মলেন্দু গুণ মুক্তিযুদ্ধ ও সামরিক শাসন বিরোধী কবিতা লিখছেন। শামসুর রাহমানকে যদি বলি, নূর হোসেনকে আমাদের সামনে পোট্রেট করে দিচ্ছে কবিতার মধ্য দিয়ে।  এবং বলছেন, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো হয়ে যায়। তিনি বলছেন, ধন্য রাজা ধন্য/দেশ ভরা তার সৈন্য। আমি মোহম্মদ রফিকের কথা বলতে পারি। তিনি কবিতার লাবন্য ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বলছেন যে, সব শালা কবি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আবার কবিতায় আন্তর্জাতিকতাবাদ স্থান পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পরে এরকম আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা কিন্তু আমরা খুব একটা দেখতে পাইনা। সেই সময় নেলসন মেন্ডেলাকে নিয়ে সাড়া পৃথিবীতে একটা হৈচৈ চলছিল। আমাদের কবিরা কিন্তু পিছিয়ে থাকে নি। নেলসন মেন্ডেলাকে নিয়ে খেলা হয়েছে কবিতা। সব মিলিয়ে আমরা আবৃত্তি শিল্পীরা বড় মোহনায় এসে দাড়ালাম। মনে হল যেন ইতিহাস প্রতিনিয়ত রচনা করে চলেছেন কবিরা, আর আবৃত্তিশিল্পীদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিদিন সেই ইতিহাস কন্ঠে তুলে মানুষের কাছে বলা।


জেমস আনজুস: সাংস্কৃতি আন্দোলনের সেই যে জায়গাটা, এখন কি স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে?

হাসান আরিফ: আমি খুব স্পষ্ট করে বলি, আমরা কিছু কিছু জায়গায় কিন্তু ভুল করি। আমি যদি বায়ান্ন এর ভাষা আন্দোলনকে ধরি, তাহলে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম  দিচ্ছে। যখন এই জনপদের ব্যাপক মানুষ এই অধিকারে আদায়ের আন্দোলনকে জীবনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। এবং সেই ধারাবাহিকতায় যখন মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে আসে, তখন দেখুন যে সৃজনশীল জায়গাটা একদম পরিষ্কার। সেটা পচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল। তারপর সেটা থমকে যায়। আশির দশকের গোড়ায় আবার সৃজনের জায়গাটা পুনরায় ফিরে আসে। তারপর রাষ্ট্রে সকলের দায় ছিল ঐক্যবদ্ধ ভাবে চলার। সাংস্কৃতিক কর্মীরা তো তাদের লক্ষ্যে চলেছে। আমি তো বলব এরপর বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা হয়েছে, পথ নাটকের চর্চা শুরু হয়েছে, শিশুদের নাটক নিয়েও ঐক্য গড়ে উঠেছে। তার মানে হল সংস্কৃতি কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে কেও কেও বলেছেন, আমরা দলীয় হয়ে গেছি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেখবেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মোর্চায় ছিল। ২২দল, ১৫দল এরকম। তারা একটি অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে ছিল। তাদের লক্ষ্য হল স্বৈরাচারের পতন হবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে। তারপর নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর নব্বইয়ের পর আমি আবার কেন আবার আন্দোলন করলাম?  যে রাজনৈতিক শক্তি স্বৈরাচার পতনে আমার পাশে ছিল তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি।  কারণ তারা গেলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। তারা গণ-আদালতের রায় উপেক্ষা করে চব্বিশজন বরেণ্য ব্যক্তিকে দেশদ্রোহী করেছে। তখন আমি আন্দোলন করেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করেছি। আজ  আমাকে বলা হচ্ছে আমি কোন দলের হয়ে কাজ করছি। আমি কি আসলে কোন দলের হলাম? আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিষয়ে ঢালাও ভাবে বললে হবেনা। পরবর্তীতে দেখেছি, নির্বাচিত সরকারে আমলে বোমা হামলা হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি। তারপর বাংলাভাই এসেছে। তারা ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে। আমার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যখন তারা চলে গেল, সংগত কারণেই তাদের বিরুদ্ধে আমি আমার অবস্থান জানিয়েছি।  এখন আমি বলছি, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়েছি। এটাই কি প্রথম কথা? না। ফেরদৌসী মজুমদার যখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় উচ্চারণ করেছে, তখন কি মনে হয় নি আমরা সংস্কৃতি কর্মীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচারই চাইছি। আমরা যখন রাজাকারের মুখোশটা উন্মোচন করার জন্য দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছি, তাও কি মনে হয় না সংস্কৃতি কর্মীরা কাজ করছে। রাষ্ট্রিয় সমস্যাগুলোর সমাধান করবে রাজনৈতিক দলগুলো। এটি রাজনৈতিক লড়াই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সংস্কৃতি কর্মীরা তো ক্ষমতায় গিয়ে দেশ পরিচালনা করবে না। আমরা আমাদের দাবিগুলো জানাব, আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। আমার জন্মলগ্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার যে সংগ্রাম, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার যে সংগ্রাম;সেই সংগ্রামের কিছু কিছু যখন কোন রাজনৈতিক দল পূরণ করে, তখন আমার মনে হতে পারে আমার দাবিগুলো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মীদের  দাবি যদি কোন দলের কাজে ধ্বনিত হয়েছিল বলেই পাকিস্তানের ২৩ বছরের যে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে ৭ মার্চ বাঙালির জীবনে একজন মাত্র নেতা এভাবে দৃপ্ত সাহসে বক্তৃতা করেছিলেন। যারা বলছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন হচ্ছে না, তারা বিরোধীতা করার জন্য বিরোধীতা করছেন। আমার দাবী কখনো কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সঙ্গে মিলে যায় বা দল বা জোটে সঙ্গে মিলে যায়, তার মানে এই নয় যে আমি সেই দলের কথা বলছি। হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারায় রাখবার জন্য, থাকবার জন্য যে দাবী আমরা ক্রমাগত উত্থাপন করেছি বাংলাদেশে সেই ধারাতেই ফিরে আসতে হবে এবং কখনো কখনো আমাদের সাথে কিছু কিছু রাজনৈতিক শক্তির মিল হয়, কখনো কখনো হয় না। আমি বলতে চাই, সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত হয় নাই। আমি খুব স্পষ্ট ভাবে বলি এখনও আমাদের প্রধান মঞ্চ শহীদ মিনার। আজ যদি ঘোষণা করেন সকল সাংস্কৃতিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেবেন, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক সামাজিক শক্তি থাকবেনা।



জেমস আনজুস: আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা অনেক সময় অর্থবিত্তের কাছে ম্রিয়মান মনে হয়...

হাসান আরিফ: অর্থের কাছে, প্রাচুর্যের কাছে সাংস্কৃতিক প্রবাহ বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ম্লান মনে হয়। কিন্তু সত্যিই কি ম্লান হয়, হয় না? একজন মুকুন্দ দাস কোথায় ছিলেন? একজন লালনের কতগুলো বাড়ি ছিল? একজন রবীন্দ্র নাথ জমিদার থেকে নিঃস্ব হয়েছিলেন। একজন নজরুল ভবঘুরে ছিলেন। একজন আব্বাস উদ্দীন কোথা থেকে এসেছিলেন? একজন আব্দুল আলীম কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন? একজন কুদ্দুস বয়াতি, একজন শাহ আব্দুল করিম এরা কোথায় ছিলেন? শিল্পের শক্তি এত ভয়ংকর! রাষ্ট্র যখন ইতিহাস মুছে দিতে চেয়েছে, তখন শিশু-আবাল-বৃদ্ধবনিতা ইয়াহিয়া খানকে চিনেছে। শুধু একজন শিল্পী একটি মুখমন্ডল এঁেকছিল। আসল ছবি না দেখেও শুধু শিল্পীর আকা ছবি দেখে মানুষ ইয়াহিয়া খানকে চিনে ফেলেছিল। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে ম্লান মনে হয়। এটা আসলে তাৎক্ষণিক এবং একদৃষ্টিতে দেখলে এরকম হয়।  একটি কবিতার একশত বছর উদ্যাপন করা হয়। একজন কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এটি তো শিল্পের ক্ষেত্রেই সম্ভব।  আবার আপনি দেখবেন যে আমাদের দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা  যারা ব্যান্ড সংগীত করে তারা এখন হাসন-লালনের গান করে। এটাই শেকড়মুখী হওয়ারই প্রবণতা।

জেমস আনজুস: সাংস্কৃতিক অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে আবৃত্তি কি রাষ্ট্রিয়ভাবে অবহেলিত মনে করেন?

হাসান আরিফ: বিগত সরকার যে নতুন শিক্ষা নীতি করছে সেখানে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে আবৃত্তি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আমরা সে খবর রাখি না। দীর্ঘদিন পর শিল্পকলা একাডেমী আবৃত্তি বিভাগ করেছে। এটা তো স্বীকৃতিরই বিষয়। আবৃত্তির ক্ষেত্রে টেলিভিশনে গ্রেডেশন হয়েছে। তবে শিল্পকলা একাডেমী জেলা পর্যায়ে যেটা হয়, সেখানে ডিসি সাহেব প্রধান হয়। এখন একজন শিল্পীর সবমহলে পরিচিত হতে হতে ষাট বছর বয়স হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। যাকে আমরা বলি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এখন সেই শিল্পী কি ডিসিকে স্যার বলে তার অধীনে কাজ করা করবে, এটা কি সম্ভব? উপনিবেশিক এই কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। কাঠামো ভেঙে কাঠামো তৈরি করতে হবে। এভাবেই হতে হবে। প্রথমে ব্যক্তিই এগিয়ে যায়, তারপর সমষ্টি তার পেছনে যায়।

জেমস আনজুস: আমাদের দেশে আবৃত্তিশিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে যদি কিছু বলুন।

হাসান আরিফ: শিল্পের লড়াইটা সংখ্যায় নয়, শিল্পের লড়াইটা সৃজনে। সংখ্যা প্রদর্শন করে শিল্পের শক্তি বিবেচনা করা যায় না।১৬ কোটি মানুষের মধ্যে যাদের  গান বা আবৃত্তি শোনবার ব্যবস্থা আছে, তাদের মধ্যে কতজন আবৃত্তি শোনে তার ওপর নির্ভর করবে আবৃত্তির বিস্তৃতি কতটুকু হল। গণমাধ্যম গুলো কতটা বাধ্য হচ্ছে আবৃত্তি প্রচার না হলে চলছে না, তার ওপর নির্ভর করে আবৃত্তি কতটুকু বিস্তৃতি হচ্ছে। ব্যাপক গণমাধ্যমের প্রসার যখন হচ্ছে , তখন তারা নিবেদিত হলে এমন শিল্পী বেড়িয়ে আসবে যিনি একাই আবৃত্তির দিগন্তকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে। অন্য রকমভাবে এর আবেদন তৈরি করতে পারবে। মানুষের মনে আবৃত্তির স্থান করে দিতে পাবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কোথাও নেই- ওস্তাদ পি. সি. গোমেজ (গমেজ)

পি.সি. গমেজ রচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ - †Rgm AvbRym evsjv‡`‡ki cÖL¨vZ D”Pv½m½xZ wkíx cvm Kvjm Pvj©m M‡gR(wc. ...