
নারী হল স্রষ্টা। তাই যে কন্যাশিশু একদিন মা হবে- সংসারে তাকে যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাউকে-না-কাউকে নিতে হবে। কারণ সংসার দাড়িয়ে থাকে নারীর ছায়ায়। মায়ের ছায়ায়।
নেপোলিয়ান বলেছেন, আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেব। তবে বাস্তবতা হল, নারীকে রান্নাঘরের ভিতরে বসিয়েই পুরুষ সমাজ উদ্ধার করে। ফলে শিক্ষার অভাব( শিক্ষা মানে গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেট নয়, আপনার আচরনই আপনার সার্টিফিকেট), সমাজ-সংসারে পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ এক শ্রেনীর নারী ঘরকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চায়, যার পরিণাম একটি স্থবির সংসার। এই অসুখ থেকে নারীদের মুক্তি সম্ভব, যদি গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি নারী অন্য কিছু করে। ঘরকন্নার পাশাপাশি গান জানলে চর্চা রাখতে পারে, ছবি আঁকা জানলে আঁকতে পারে, গল্প উপন্যাস পরতে পারে বা লিখতে পারে, হস্তশিল্পজাতীয় কাজ করতে পারে, স্কুল পড়াতে পারে বা কোন চাকরি করতে পারে। এতে হয় কি, মনটা ভাল থাকে। ব্রেনকে ভাল কাজে ব্যস্ত রাখলে মনটা ভাল থাকে। তবে মনে রাখবেন, সুস্থ ও গ্রহনীয় আচরণ দিয়েই পরিবারে আস্থা অর্জন করতে হবে আপনাকে। এই আস্থা হল বিশ্বাসের আস্থা। ঘরের বাইরে বা সামাজিক পরিসরে আপনার পরিবার ও সংসারের প্রতি আপনি কতটা বিশ্বস্ত থাকবেন, সেটাই আপনার স্বাধীনতার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করবে। আপনি আপনার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ, সেটাই আপনার স্বাধীনতা। কচুরিপানার স্বাধীনতা হল ভেসে যাবে স্রোতের সাথে, মানুষ কচুরিপানা নয়।
সংসার ভেসে থাকে সম্পর্কের নৌকোয়। সম্পর্কে ঘুন ধরলে নৌকা ফুটো হয়ে শেষমেষ ডুবে যায়। সম্পর্ক, সংসার, সমাজ- এই তিন ‘স’ নিয়েই মানুষের সবকিছু। যে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে শেয়ারিং আছে, সে পরিবারে সমস্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। পরিবারে শেয়ারিং বা যেকোনো বিষয়ে ঘরের সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধা
প্রতিবেশী হল সেই মানুষ যাকে আপনার ইচ্ছা না হলেও ঘর থেকে বের হয়ে দেখতেই হবে। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, বিদেশী কসমেটিকস আর নিত্য নতুন প্রযুক্তির চেয়ে সম্পর্ক অনেক বড়। তাই প্রতিবেশীর সাথে ভাল সম্পর্ক থাকলে মানসিকভাবে আপনি সুস্থ থাকবেন। একটা টিক্স শিখিয়ে দেই। টিক্সটা আমার না, শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র। তিনি বলেছেন, “ সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি, যাহাতে গৃহকর্তা বা গৃহিনীকেস্নিগ্ধ করি, তাহার নাম প্রণয়, যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী, যাহা দ্বারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম শিষ্টাচার। চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ম পাই। অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।” এর মানে ভাবার কারণ নাই জগতের সবকিছুই তৈলের ওপর ভাসমান। ভাসুক আর না-ভাসুক তৈল দ্বারা সমাজ-সংসারে মঙ্গল হয় নিশ্চয়ই। তৈল সবার ভেতরই আছে তবে অধিক স্বার্থপর মানুষ অন্য কাওকে তৈল দিতে পারে না। তৈল না দিলে যে ক্ষতি হয় তা-ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলে গেছেন- “ যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মুল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ্য টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।” এই তৈল প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বৌ শাশুড়িকে, শাশুড়ি বৌকে; শুধু বৌ-শাশুড়ি কেন ননদ-জাল-ভাসুর-শশুড় সবাইকেই ইনক্লুড করতে পারেন। মনে রাখবেন কুটনামির অভ্যাস থাকলে তৈল ফর্মুলা কোন কাছে দেবে না। শেক্স পিয়র সাহেব তো বলেই গেছেন যে, এই জগত-সংসার রঙ্গমঞ্চ আর আমরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাহলে নায়ক হবেন না ভিলেন হবেন, নায়িকা হবেন না ডাইনি হবেন? কেন শুধু শুধু এই রঙ্গমঞ্চে নেগেটিভ চরিত্র নিবেন। চরিত্র নিলে ভালটা নিবেন। আপনি মরার পরে যেন দশজনে বলে, আহ্ খুব ভাল মানুষ ছিল। ভিলেন মরলে পাবলিক হাত তালি দেয়, তাহলে জগত-সংসারে কেন ভিলেন হবেন। চোখ-কান খোলা রাখুন। সুযোগ সন্ধানী মিষ্টভাষীদের এড়িয়ে চলুন। যার ভালবাসায় মন ভয়ে যায়, তার শাসনে ভুল করেও তাকে ভুল বুঝবেন না। সংসারে একে অপরের সম্পর্ক খুবই সাধারণ, তা মেইনটেইন করতে সার্টিফিকেট লাগে না, কিন্তু চরম স্বার্থচিত্ত সংসার কী জিনিস বুঝতেই দেয় না। আমি বলি কী, সামাজিক সম্পর্কটা বজায় রাখুন, কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করুন বুঝে শুনে। তবে সুখ এত সহজ বিষয় নয়, কাওকে-না- কাওকে এজন্য ছাড় দিতে হয়। পরিবারে কাওকে- না- কাওকে অনেক বড় হৃদয়ের অধিকারী হতে হয়। যে হৃদয়ে কষ্ট সইবার হিম্মত আছে, আছে ভালোবাসা ছড়ানোর শক্তি। একটি কবিতায় পড়েছিলাম- কিছু না পাওয়ার চেয়ে, ভালোবেসে কষ্ট পাওয়াও ভাল।

সংসারে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও আছে। আপনার পাশের বাড়িটি হতে পারে নিম্নবিত্ত পরিবার। আপনার পরিবারে আয় বেশি বলে তাদের খাটো করে দেখার কিছু নাই। অর্থ-বিত্তের অহংকারে নিজেকে আলাদা করে রাখতে গিয়ে কখন যে চার দেয়ালে আটকে যায়, সে মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না। আবার আপনি নিম্নবিত্ত বলে যার বেশি আছে তাকে হিংসে করার কিছু নাই। বরং মানুষ হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৃপনতা করাটা অন্যায়। তাতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ফর্মুলা আপনার কাজে লাগল না। কারণ অর্থবিত্ত যখন সম্পর্কের মাপকাঠি হয়, ভোগবাদে মানুষ চোখে রঙিন দুনিয়া দেখে। তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না- শপিং মলের বাহারি পণ্যের ভেতর আটকে যায় মানুষের আত্মা। আমার এক বন্ধু একদিন বলেছিল, “এই যে আমরা স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন চোখ বন্ধ করে শুধু প্রার্থনা করি; কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে আমরা কতটুকু ঈশ্বরের দেখানো পথে চলি। আমরা তো নিজেরাই আমাদের পরিবারকে স্বর্গ বানাতে পারি।” কথাটা ভেবে দেখেছেন, কী সাংঘাতিক কথা! একটু চেষ্টা করে দেখুন না! হাল ছেড়ে দিবেন না। বাধাঁ আসবে, ব্যর্থ হবেন। তবে নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন, শত ঝড়ও আপনাকে টলাতে পারবেনা। হেটে চলুন, একদিন ঠিকই আপনি আপনার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছে যাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন