বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৫

সম্পর্কের পাটিগণিত : সংসারে নারী চরিত্র - women in family








নারী হল স্রষ্টা। তাই যে কন্যাশিশু একদিন মা হবে-  সংসারে তাকে যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাউকে-না-কাউকে নিতে হবে। কারণ সংসার দাড়িয়ে থাকে নারীর ছায়ায়। মায়ের ছায়ায়।

নেপোলিয়ান বলেছেন, আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেব।  তবে বাস্তবতা হল, নারীকে রান্নাঘরের ভিতরে বসিয়েই পুরুষ সমাজ উদ্ধার করে। ফলে শিক্ষার অভাব( শিক্ষা মানে গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেট নয়, আপনার আচরনই আপনার সার্টিফিকেট), সমাজ-সংসারে পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ এক শ্রেনীর নারী ঘরকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চায়, যার পরিণাম একটি স্থবির সংসার। এই অসুখ থেকে নারীদের মুক্তি সম্ভব, যদি গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি নারী অন্য কিছু করে। ঘরকন্নার পাশাপাশি গান জানলে চর্চা রাখতে পারে, ছবি আঁকা জানলে আঁকতে পারে, গল্প উপন্যাস পরতে পারে বা লিখতে পারে, হস্তশিল্পজাতীয় কাজ করতে পারে, স্কুল পড়াতে পারে বা কোন চাকরি করতে পারে। এতে হয় কি, মনটা ভাল থাকে। ব্রেনকে ভাল কাজে ব্যস্ত রাখলে মনটা ভাল থাকে। তবে মনে রাখবেন, সুস্থ ও গ্রহনীয় আচরণ দিয়েই পরিবারে আস্থা অর্জন করতে হবে আপনাকে। এই আস্থা হল বিশ্বাসের আস্থা। ঘরের বাইরে বা সামাজিক পরিসরে আপনার পরিবার ও সংসারের প্রতি আপনি কতটা বিশ্বস্ত থাকবেন, সেটাই আপনার স্বাধীনতার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করবে। আপনি আপনার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ, সেটাই আপনার স্বাধীনতা। কচুরিপানার স্বাধীনতা হল ভেসে যাবে  স্রোতের সাথে, মানুষ কচুরিপানা নয়।

 সংসার ভেসে থাকে সম্পর্কের নৌকোয়। সম্পর্কে ঘুন ধরলে নৌকা ফুটো হয়ে শেষমেষ ডুবে যায়। সম্পর্ক, সংসার, সমাজ- এই তিন ‘স’ নিয়েই মানুষের সবকিছু। যে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে শেয়ারিং আছে, সে পরিবারে সমস্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। পরিবারে শেয়ারিং বা যেকোনো বিষয়ে ঘরের সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধা

ন্ত নিলে পারিবারিক বন্ধন শক্ত হয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ শেয়ারিংয়ের অভাব। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত  যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা না করে একক ভাবে গ্রহন করা হয়, তাহলে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়। তারা ভাবে পরিবার তাদের মূল্যায়ন করছে না। ফলে এক ছাদের নিচে অনেক বড় দূরত্ব সৃষ্টি হয়।। সামাজিকভাবে আমরা কতশত বিষয় নিয়ে কত শেয়ারিং করি, কিন্তু পরিবারের ক্ষেত্রে সেই গুরুত্ব আমরা কতটুকু অনুধাবন করি? ভাবতে হবে। ছেলের পরিবারকে বুঝতে হবে, একটি মেয়ে মা-বাবা, ভাইবোন ফেলে নতুন এক জায়গায় আসে। তাই নতুন বউকে সবার সহযোগিতা করা দরকার।  নতুন চাকরিতে গেলেও তো কাজ বুঝিয়ে দিেেত হয়, তাই না? একজন মা তার মেয়েকে শুধু একটি ছেলের হাতে তুলে দেয় না, একটি পরিবারের হাতেও তুলে দেয়। শশুড় বাড়ীতে নতুন বউ শুরু থেকে সবার ভালবাসা, আদর পেলে সে ভিন্ন কিছু বা খারাপ কিছু চিন্তা করতে চাইবে না। তবে আপনি স্ত্রী, শশুড় বাড়িকে পরের বাড়ি ভাবার মানসিকতা ধীর ধীর মুছে ফেলুন। অর্থাৎ নিজের করে ভাবলে অনেক সমস্যার সমাধান আপনি নিজেই করতে পারবেন। স্বামীর উপার্জন থেকে পরিবারের অন্যদের বঞ্চিত করার মানসিকতা দূর করুন। সুখ পাবেন। আর সুখের জন্য তো আমরা সবাই পাগল, তাই না? যৌবনে ভালবাসার নদীতে ভাসতে চায় সকলে। আর অনেকে ভাসেও। কখনো অঙ্ক মিলে যায়, তবে অধিকাংশ সময়ে মিলে না উত্তর। আর না মিললেই সৃষ্টি হয় চোরা সম্পর্কের ফোল্ডার। তাড়াতাড়ি ডিলিট করুন, রিসাইকেল বিন থেকেও ডিলিট করুন। তারপর প্রবেশ করুন নতুন জীবনে। প্রথমেই জানিয়ে দিন ভুল অঙ্কের হিসাব-নিকাশ। অন্যথায়, বিশ্বাসের ঘরে ঘুনপোকারা জেগে উঠতে পারে। আগে লোকমুখে একটা কথা শোনা যেত। কথাটা হল, প্রযুক্তি আমাদের  দিয়েছে গতিবেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ। কিন্তু কথাটা আংশিক সত্য। ফেসবুকে সাময়িক কৌতুহলের মোহে এমন কিছু করবেন না, যে সারা জীবন শুধু সুদ-ই গুণে যাবেন- আসল আর শোধ হবে না। তিাই স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ পানির মত সম্পর্ক স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ রাখুন। নয়তো অসুখ হবে,  ডাক্তার খুঁজে পাবেন না। যেখানে দুই দেহ এক আত্মা- দয়া করে সেখানে চালাকির আশ্রয় নিবেন না। কিছুদিন আগে এক মুরুব্বি দুঃখ করে বলছিলেন, ‘স্বামী হল আইডি কার্ড। শুধু টাকা দেওয়ার মালিক। কয়জন স্ত্রী তার স্বামী পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।




প্রতিবেশী হল সেই মানুষ যাকে আপনার ইচ্ছা না হলেও ঘর থেকে বের হয়ে দেখতেই হবে। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক,  বিদেশী কসমেটিকস আর নিত্য নতুন প্রযুক্তির চেয়ে সম্পর্ক অনেক বড়। তাই প্রতিবেশীর সাথে ভাল সম্পর্ক থাকলে মানসিকভাবে আপনি সুস্থ থাকবেন। একটা টিক্স শিখিয়ে দেই। টিক্সটা আমার না, শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র। তিনি বলেছেন, “ সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি, যাহাতে গৃহকর্তা বা গৃহিনীকেস্নিগ্ধ করি, তাহার নাম প্রণয়, যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী, যাহা দ্বারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম শিষ্টাচার। চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ম পাই। অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।” এর মানে ভাবার কারণ নাই জগতের সবকিছুই তৈলের ওপর ভাসমান। ভাসুক আর না-ভাসুক তৈল দ্বারা সমাজ-সংসারে মঙ্গল হয় নিশ্চয়ই। তৈল সবার ভেতরই আছে তবে অধিক স্বার্থপর মানুষ অন্য কাওকে তৈল দিতে পারে না। তৈল না দিলে যে ক্ষতি হয় তা-ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলে গেছেন- “ যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মুল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ্য টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।” এই তৈল প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বৌ শাশুড়িকে, শাশুড়ি বৌকে; শুধু বৌ-শাশুড়ি কেন ননদ-জাল-ভাসুর-শশুড় সবাইকেই ইনক্লুড করতে পারেন। মনে রাখবেন কুটনামির অভ্যাস থাকলে তৈল ফর্মুলা কোন কাছে দেবে না। শেক্স পিয়র সাহেব তো বলেই গেছেন যে, এই জগত-সংসার রঙ্গমঞ্চ আর আমরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাহলে নায়ক হবেন না ভিলেন হবেন, নায়িকা হবেন না ডাইনি হবেন? কেন শুধু শুধু এই রঙ্গমঞ্চে নেগেটিভ চরিত্র নিবেন। চরিত্র নিলে ভালটা নিবেন। আপনি মরার পরে যেন দশজনে বলে, আহ্ খুব ভাল মানুষ ছিল। ভিলেন মরলে পাবলিক হাত তালি দেয়, তাহলে জগত-সংসারে কেন ভিলেন হবেন।  চোখ-কান খোলা রাখুন। সুযোগ সন্ধানী মিষ্টভাষীদের এড়িয়ে চলুন। যার ভালবাসায় মন ভয়ে যায়, তার শাসনে ভুল করেও তাকে ভুল বুঝবেন না। সংসারে একে অপরের সম্পর্ক খুবই সাধারণ, তা মেইনটেইন করতে সার্টিফিকেট লাগে না, কিন্তু চরম স্বার্থচিত্ত সংসার কী জিনিস বুঝতেই দেয় না। আমি বলি কী, সামাজিক সম্পর্কটা  বজায় রাখুন, কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করুন বুঝে শুনে। তবে সুখ এত সহজ বিষয় নয়, কাওকে-না- কাওকে এজন্য ছাড় দিতে হয়। পরিবারে কাওকে- না- কাওকে অনেক বড় হৃদয়ের অধিকারী হতে হয়। যে হৃদয়ে কষ্ট সইবার হিম্মত আছে, আছে ভালোবাসা ছড়ানোর শক্তি। একটি কবিতায় পড়েছিলাম- কিছু না পাওয়ার চেয়ে, ভালোবেসে কষ্ট পাওয়াও ভাল।







সংসারে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও আছে। আপনার পাশের বাড়িটি হতে পারে  নিম্নবিত্ত  পরিবার। আপনার পরিবারে আয় বেশি বলে তাদের খাটো করে দেখার কিছু নাই। অর্থ-বিত্তের অহংকারে নিজেকে আলাদা করে রাখতে গিয়ে কখন যে চার দেয়ালে আটকে যায়, সে মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না। আবার আপনি  নিম্নবিত্ত  বলে যার বেশি আছে তাকে হিংসে করার কিছু নাই। বরং মানুষ হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৃপনতা করাটা অন্যায়। তাতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ফর্মুলা আপনার কাজে লাগল না। কারণ অর্থবিত্ত যখন সম্পর্কের মাপকাঠি হয়, ভোগবাদে মানুষ চোখে রঙিন দুনিয়া দেখে। তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না- শপিং মলের বাহারি পণ্যের ভেতর আটকে যায় মানুষের আত্মা। আমার এক বন্ধু একদিন বলেছিল, “এই যে আমরা স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন চোখ বন্ধ করে শুধু প্রার্থনা করি; কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে আমরা কতটুকু ঈশ্বরের দেখানো পথে চলি। আমরা তো নিজেরাই আমাদের পরিবারকে স্বর্গ বানাতে পারি।” কথাটা ভেবে দেখেছেন, কী সাংঘাতিক কথা! একটু চেষ্টা করে দেখুন না! হাল ছেড়ে দিবেন না। বাধাঁ আসবে, ব্যর্থ হবেন। তবে নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন, শত ঝড়ও আপনাকে টলাতে পারবেনা। হেটে চলুন, একদিন ঠিকই আপনি আপনার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছে যাবেন। 

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

শিক্ষা নিয়া দুইডা কতা আছিল... Understanding Education...




শিক্ষা নিয়া বহু জ্ঞানী-গুণী অনেক কথা কইছে। তয় আমারও কিছু কইবার মন চাইল। শিক্ষা নিয়া বড় দুঃচিন্তায় পরছি। দুঃচিন্তার হাজার কারণের মধ্যে জব মার্কেটের অনিশ্চিতা প্রধানতম প্রতীয়মান হইতাসে। হুম, মানব সভ্যতা চলবার লাগছে অর্থনীতির উপর বেইজ কইরা। আর বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির জমিদারী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাতে। সে বলে যে, যাদের ব্যবসা-বাট্টা ভাল তারাই উন্নত, হেইডা মাইর‌া –কাইটা য্যামনে ইচ্ছা করেন। এই হাওয়ার বাইরে যাওয়ার উপায় আমাগো নাই। তাই প্রথমে নিজের অর্থনীতির উন্নতির চিন্তা করা লাগে। সেই দিক বিবেচনা করলে অথবা না-করলেও মাস শেষে একটা ভাল এমাউন্টের বেতন ছাড়া আজকের বাজারে চলার উপায় আছে? চাল বলেন আর ডাল- হিসেব কইরা কিনবার গেলে আলু কিন্যা বাড়ি ফিরন লাগবো। তো এই অইল আমাগো বর্তমান অবস্থা। অর্থাৎ আমরা এমন এক সিস্টেম তৈয়ার করলাম, যার জন্য আমাদের অলটাইম দৌড়ের উপর থাকতে অয়। অর্থাৎ অর্থ এবং অর্থ সংক্রান্ত সকল নীতিই হইল আসল, বাকি সব নকল। না, বিষয়টা এভাবে কইলেও, ইহা সমাধানের তরিকা আমার জানা নাই। তয় আপনের চিন্তায় নতুন কিছু যোগ হয়, এই আশায় বাক্য ব্যয়ের প্রয়াস পাইলাম।

আপনে যা-ই করতে চান ট্যাকা দরকার। যেমন আপনার গিটার বাজাতে ভাল্ লাগে- একটা নির্মল আনন্দ- সেই গিটার কিনতে হবে টাকার বিনিময়ে। অথচ নির্মল আনন্দটা ট্যাকা দিয়া কিনতে পারেন না। ট্যাকা হইলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়, আর টাকা না হইলে গরুর দুধও পাওয়া যায় না। তাইলে ট্যাকার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার যে করে, সে পাগল। আবার ৫০ টাকা দরে চাল কিনা খাইলেও আপনার কিছু করার নাই। মানে সিস্টেম তো আপনে ভাঙতে পারেন না, অথবা ৫০টাকা দরে চাল কেনা আমার-আপনের জন্য সমস্যা হইলেও সিস্টেমকর্তারা যদি আগের মতই মুখে হাসি নিয়া বসে থাকে, বুঝবেন যে সিস্টেম ইজ ওকে। তাই এই সিস্টেম নিয়া মহাবিতর্ক আছে। মহাবিতর্কের দুই সন্তান- সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র(পুঁজিবাদ)। এই লেখাতে যে সিস্টেমকর্তার কথা কইতাছি, তারা পুঁজিবাদের গর্ভজাত। যাগ্গে, আপনার উদ্দেশ্য গিটার বাজানো বা ভাত খাওয়া, আর এই কার্য সিদ্ধির জন্য চাই ট্যাকা। তাই ইচ্ছা না থাকলেও আপনাকে টাকার পেছনে ছুটবে হবে, সিস্টেম তাই বলে।  কিন্তু টাকা খুঁজতে খুঁজতে আপনি যদি নিজেরে হারায়ে ফেলেন(মানুষ থেইক্যা জঙ্গলি), সিস্টেম এর দায় নিবে না। যাইক্গা, ব্যবসা বা চাকরি বা কিছু একটা করে তো কামাই করতে হয়। এই কামাই সৎ না অসৎ পথে- এইটা একটা আলোচনার বিষয় হতে পারে। আরেকটা হইতে পারে কামাইটা কী উদ্দেশ্যে: এক.খাওনের জন্য; দুই. খাওন ও নিজের (অসীম)শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য; তিন. খাওন ও মানুষকে ডমিনেট করার জন্য; চার.  খাওন ও ভাল কাজে সহযোগিতা করার জন্য। শেষেরটার জন্যই কিন্তু পৃথিবীতে সব ভাল কাজ হয়(আবার ভাল হইতে পয়সা লাগে না)। আর যত যত সমস্যা দেখেন তিন নম্বরটার জন্য। দুই নম্বরটাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা মানুষকে কদাচিৎ বুকা বানিয়্যা থাকে।  আইজকাইল দ্যাহা যায় যে, তিন নম্বর উদ্দেশ্যটা দুই নম্বরকে সিস্টেমে ফেলে নতুন কায়দায় ডমিনেট করে থাকে। তাইলে তিন নম্বর ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভাল মিল আছে। বিতর্কটা তখনই চোখে পড়ে- যখন ভাবতে হয় আমি মানুষের পক্ষে থাকুম না সিস্টেমের পক্ষে থাকুম । যার খাওনের টাকা নাই তার জন্য কি ঈশ্বরের দোহাই দিয়া চুপ কইর‌্যা থাকুম, না উপরঅলাদের সিস্টেমের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান জানামু ?



শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গিয়া অর্থনীতি আইয়্যা পড়লো। যাক্, এবার শিক্ষা বিষয়টা নিয়া কথা বাড়াই। শিক্ষা নিয়্যা কথা বললে শুনব ক্যারা, কারণ অর্থনীতি দলবল নিয়া হার্টে এ্যাটাক করে। ইস্, অর্থনীতিও শিক্ষার বাইরে না। যাইক্গে, তার চে বরং শিক্ষার প্রকৃত বা অ-আর্থিক বিষয় নিয়া একটু বাতচিৎ করি।  ধরেন লালন সাঁই, সে আবার কেমন শিক্ষিত ছিলেন? একটা সার্টিফিকেটও ছিল না, আবার টাকা-পয়সাও ছিল না- না করছে চাকরি, না করছে ব্যবসা- বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা কইরা খাইতো- ওই ব্যাটা তো হিসাবে কোন পর্যায়েই পড়ে না। কিন্তু তারে নিয়া মানুষের মাতামাতির তো শেষ নাই। বিস্তর গবেষণা হইতেছে তার মুখের বাণী নিয়া। মানুষরে তিনি কী শোনাইলেন যে তারে নিয়া শিক্ষিতেরা রিসার্স করে! তাইলে আমরা যে এত পড়াখেলা করতাছি-  অনেক ডিগ্রি আছে আমার- আমাগো নিয়া তো কারো কোন চিন্তাই নাই । তাইলে আমরা কী শিক্ষিত হইলাম। বলি না যে আমাগো নিয়া ভাবতে হইব, কিন্তু সার্টিফিকেট এর ওপর বেইজ করে বইসা থাকাটা রিস্কি হইয়া যায় না? এই যে বাচ্চা বয়েস থেইকা বই নিয়া দৌঁড় পারতাছি- কী শিখতাছি। কী শিখা শিক্ষিত হইলাম? সক্রেটিস কার বই পইড়া এত পন্ডিত হইলো? এইখানে শিক্ষা নিয়া ভাবার একটা প্লট আছে, এই প্লটে একটু নজর দেন- জীবনে একটা অন্যরকম গতি অথবা মন্থর ভাব ঠিক-ই লক্ষ্য করবেন। আসলে আপনি বাইরে শুধু দেখবেন: যেমন মানুষের কান্ড, প্রকৃতির কান্ড বা বইয়ের মধ্যে বহু রকমের কান্ড; কিন্তু শিখতে হইবো নিজেকে ঝালাই কইরা-ই। যে নিজেকে ঝালাই (নিজেরে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখা, পৃথিবীটা ও মানুষ নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখা,এমনকি অদেখারেও ) করছে সে-ই শিক্ষিত হইছে। সিক্রেটিসও সেরকম ছিলেন- লালন, কার্ল মার্ক্স, রবীন্দ্র নাথ, আইনস্টাইন, ডারউইন এরা প্রত্যেকেই এবং আরো অনেকে আছেন; ভবিষ্যতেও অনেকে হবেন।

আমার মনে হয় শিক্ষার মূল কাজটা আত্মিক আর এর চর্চার মধ্য দিয়াই প্রাণী থেকে আমরা মানুষ হইয়া উঠি। কিন্তু এই জায়গাটায় পুঁজিবাদ শিক্ষার লগে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করতাছে। ফরমালিটিসের টাই আমাগো গলায় ঝুলাইয়া নিজের বাপ-দাদার সম্পর্ক ভুলাইয়্যা এক গ্লোবাল ভিলেজ তৈয়ার করল পুঁজিবাদ। যেখানে আমার হাজার বছরের ইতিহাসের দাম নাই। পুঁজিবাদের একটা ছোট্ট বিষক্রিয়া হইল আর্টসের প্রতি পোলাপানের উদাসীনতা। দেখেন, বান্দুরা স্কুল থেইক্যা আর্টস উঠাই দিছে, অথচ আমরা যে এত নীতির কথা বলি, মূল্যবোধের কথা বলি, সমাজের কথা বলি- এগুলা পোলাপান কই শিখবো- একাউন্টিং পইড়া নাকি? এই আর্টস কমদামি হইয়া গেল, তার পেছনেও কাঠি ঘুরাইতেছে বাজার অর্থনীতির নিষিদ্ধফল। এখনতো বাঙলা দ্বিতীয় পত্রের সারাংশ, সারমর্ম আর ভাব-সম্প্রসারণ ছাড়া ভদ্রলোক হইবার লেখাপড়া দেখি না। যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিন্তা করি, মেট্রিক পর্যন্ত এই কথা মানতেই হইব। এইখানে পরিবারের দায়িত্বটা অনেক বাইড়্যা গেল মা জননী।

প্রভাববিস্তার, ক্ষমতার দাপট, স্বার্থপরতা- বাজার অর্থনীতি আমাগো শিখাইতাছে। একটা মানুষের কান্না থেইক্যা একটা বিজ্ঞাপন আমার কাছে মূল্যবান হয়ে উঠে। প্রযুক্তির কান টেনে বাজারে পাঠিয়া স্থুল বিনোদনে পরিণত করা অইতাছে। অর্থনীতির কী দোষ- তারে তো  আমরাই টাইন্যা বাজারে নামাইছি। শিক্ষিত মানুষ শোয়ালের মত ধূর্ত নয়, শিক্ষিত মানুষ বুদ্ধিমান। বুদ্ধির জায়গাতে যখন চালাকি আসন পাতে, তখন গোলমাল বাঁধে। আমরা ধূর্ত হইবার চাই না, আমাদের চাতুরতার সমাজব্যবস্থা আমাদের ধূর্ত হইবার টেকনিক শিখায়। তাই আমরা তো শিক্ষিত হইবার চাই না, আমরা চাই স্ট্যাটাস। তাই নুন আন্তে পানতা ফুরায় অবস্থায় পড়ে শিক্ষার আক্ষরিক উপাধি নিয়া মাথা উচু করে বাঁচতে চাই। আর তাতে উপরঅলারা খুব একটা ব্যাজার হন না বোধ করি।


একটা সময় মুরুব্বিরা স্টুডেন্টদের  পছন্দ করতো। তাগো লগে গল্প করতো। আর এ্যহন তারা স্টুডেন্ট দেইখ্যা ভয় পায়। কারণ কখন কী উল্টাপাল্টা কইর‌্যা ফালায়! মানে স্টুডেন্টদের মধ্যে চিন্তাশীলতা, সচেতনতা, শিষ্টাচার নাকি লোপ পাইছে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কোন আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায় না। এক সময় স্টুুডেন্টরা সমাজ ও রাষ্ট্রের মোষ তাড়াতো আর এ্যহন দেখা যায় মোষরা তাদের নিয়া শোডাউন করে। বলতে চাইতেছি এই বিষয়গুলো ছাত্রজীবনে  ডেভেলপ না করলে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হইতে পারবেন না। রাষ্ট্রের আর সমাজের নানা সমস্যার কথা বলবেন? দেখেন সক্রেটিসও ছাড় পায় নাই, ছাড় পায় নাই যীশুখ্রীষ্ট, ছাড় পায় নাই লালনও। তাই কখনো-সখনো এসব অত্যাচার হয়ে থাকে। কারেন্ট চইল্যা গেলে আমার পক্ষে হয়ত আলাদিনের জিনের মত সবকিছু আলো করা সম্ভব না, বাট একটা মমবাতি জ্বালাইতে পারি, তাই না?


ও, একটু আগে মাথা উচু প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। আমাগো মাথা এমন উচু হইছে যে, কারো দুঃখ আমাদের বেশিক্ষণ দুঃখিত করে না; বাসস্ট্যান্ডে অথবা কাঁচাবাজারে অশ্লিল সিনেমার পোস্টার দেইখা চুপ কইরা থাকি, এলাকার ভেতর দিয়া যে রাস্তাটা ইকরাশি গেছে সেই রাস্তা ঠিক করারও ইচ্ছা করে না, টাকা না থাকলে মানুষরে চিকিৎসা করি না- একটা মানুষ শুধু টাকার অভাবে মরে যায় বিনা চিকিৎসায়? হায় রে সভ্যতা! আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এমুন পৃথিবী অইব যখন মানুষ বইতে পড়ব: কোন একসময় এমন সিস্টেম ছিল যে কয়েকটা ছোট ছোট কাগজ যাকে টাকা বলে, সেই জিনিসের জন্য মানুষ মারা যাইত। আমেন।

আমার তো মনে হয় মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হইল, ভাল আর মন্দ বোঝার ক্ষমতা। বিষয়টা ভাবলে আপনি নিজের ভেতর কিছু একটা আবিষ্কারের গন্ধ পাইবেন। কিন্তু এই ক্ষমতার চর্চা না করে মানুষ এমন এক ‘ক্ষমতা’র চর্চা শুরু করলো- সব বিষাক্ত হইয়া গেল- যেমুন আমার-আপনার মন ও মস্তিষ্ক, তেমনি পৃথিবীর পরিবেশ। শিক্ষা তার ভেতরের রূপ হারাইয়া ধূর্ত শিয়াল হইয়্যা উঠলো।

মোদ্দা কথা হইল, প্রতিযোগিতামূলক বাজার-থিউরী দিয়া শিক্ষার অর্থ উদ্ধার করতে গেলে উপরে যা পরলেন ভুইলা যান, কারণ আপনার মাথা- ই আপনার নিজস্ব সম্পত্তি। শিক্ষ্যাবিষয়ক এই লেখাটি গৌতম বুদ্ধের বাণী দিয়া শেষ করবার চাই। বুদ্ধ বললেন, ‘হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহু জনের কল্যাণের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, জগতের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ করো, ধর্মদেশনা করো; যার আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ।’

- জেমস আনজুস


আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ এর সাক্ষাৎকার- An interview of famous recitation artist Hasan Arif

শিল্পের লড়াইটা সংখ্যায় নয়, শিল্পের লড়াইটা সৃজনে:  হাসান আরিফ





খুবই ধীর স্থির স্বভাবের মানুষ। শিল্পের সাথে সংস্কৃতি এবং রাজনীতির যে সম্পর্ক, এই মেলবন্ধনে রয়েছে তার নিজস্ব্য দর্শন। মধ্য আশির দশক থেকে আবৃত্তি করছেন। বেশকিছু অ্যালবামও বের হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তিনি নির্ভীক যোদ্ধা । তার মায়ের নাম রওশন আরা। বাবা প্রয়াত আবুল ফজল মো. মফিজুল হক। কুমিল্লায় নানা বাড়িতে ৮ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহন করেন এই গুণী আবৃত্তি শিল্পী। তার সাথে কথা বলে সাক্ষাৎকারটি তৈরি করেছেন জেমস আনজুস ।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি ভাল লাগাটা কিভাবে তৈরি হল?

হাসান আরিফ: ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের পরিবারে মা-বাবা, চাচা, খালা অনেকে কবিতা পড়তেন। সেটা ঠিক আমি আবৃত্তি বলব না। তাদের কবিতা ভাল লাগত, তাই তারা সেই কবিতাগুলো আমাদের পড়ে শোনাতেন। এবং এই কবিতাগুলো  শুনে আমার মনে হল কবিতা বলার বিষয়। অর্থাৎ কবিতাটা ভাল লাগে তাই পড়া। এখানে আবৃত্তির কোন বিষয় ছিল না। যখন আমি একটু বড় হলাম, কৈশর সময় তখন। আমার এক খালাত ভাই ছিল। তিনিও খুব কবিতা বলতেন। তার অনেক কবিতা মুখস্থ ছিল। কবিতা মুখস্থ করে রাখার ব্যাপারটা তার কাছ থেকেই শিখেছি। আর আমার মায়ের কাছ থেকে ভাল বই পড়ার আগ্রহটা তৈরি হয়েছে । কারণ আমি যখন আমার নাম লিখতে শিখলাম, তখন দেখলাম আমার নাম দিয়ে মা অনেক বই কিনেছেন। সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা এধরনের  বইগুলো কেনা হয়েছে আমার অথবা আমার ভাইয়েদের  নাম দিয়ে। তার সংগ্রহে অনেক বই ছিল। এই ভাবেই কবিতা ভালা লাগা শুরু হল। আমারও মনে হল কবিতা মনে ধরে রাখি এবং অন্যদের শোনাই। তখনও কিন্তু আমি আবৃত্তি বিষয়টা জানি না। সব্যসাচী, গোলাম মোস্তফা  তাদের আবৃত্তি শুনেছি। তবে আবৃত্তি আলাদা করে বুঝলাম যে পঁচাশি সালে কামরুল হাসান মঞ্জু , তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটা কর্মশালা করলেন। তার কর্মশালা আমার আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রথম যখন আমাদের স্বাক্ষাৎকার নেন, সেদিন তার সাথে আমার আড্ডা জমে গিয়েছিল। কারণ আমার তো কবিতা জানা ছিল। আমি তার কাছে ঋণী একারণে যে, কোথাও বসে কিছু শেখা এধরনের মানসিকতা আমার ছিল না । খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। কর্মশালায় আমার মনে হল কিছু কিছু ছোট ছোট বিষয় আমি জেনে নিলেই পারি।  আমার তো কবিতা জানাই আছে। সেই কবিতাগুলোকে নতুন করে বলা। এ এক নতুন খেলা।


জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি কখন থেকে নিবেদিত হলেন?

হাসান আরিফ: ১৯৮৩ সালে স্বরিত আবৃত্তিচক্র নামে একটি সংগঠন করা হয়। এর আগে তৈরি হয় আবৃত্তি সংসদ। এটা ছিল প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে তৈরি সংগঠন। সেই বিবেচনায় স্বরিত আবৃত্তি সংঘকেই সংগঠন বলা যায়, বর্তমানে আবৃত্তি সংগঠন বলতে আমরা যা বুঝি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আশির দশকের গোড়ার দিকে শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বাচনিক  উৎকর্ষের একটি কর্মশালা করেন। সেখানে যারা যার অংশগ্রহন করেছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাবলেন একটা দল করবেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু, গীতি আরা নাসরিন, লায়লা আফরোজ, খ্রীষ্টিনা রোজারিও, আনিসুজ্জামান। তাদের এই দল করবার ভাবনাটাই ছিল আবৃত্তির সাংগঠনিক ভিত্তি। সেসময় ডাকসুতে লিয়াকত আলী লাকী সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। ডাকসুরও একটি আবৃত্তি দল করা হয়। তখন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ডাকসুর আবৃত্তিদল বৃন্দ আবৃত্তি করে  স্বাধীনতা দিবসে। সেই আবৃত্তি একটা দরজা খুলে দিয়েছিল। এরপরই ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অনেকগুলো দল তৈরি হয়ে গেল। আটাশিতে এসে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠন করা হয়। সংগঠনভিত্তিক আবৃত্তি চর্চার প্রায় শুরুর দিকে আমি আবৃত্তির সাথে যুক্ত হই।

জেমস আনজুস: স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলনে আবৃত্তি শিল্পীরা তো সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল।

হাসান আরিফ: পচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে পরবর্তী পাচ বছর শিল্প-সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত ছিল। গণজাগরণ বা গণ ধিক্কার কিন্তু হয়নি। মানুষ হতাশ হয়েছিল, অবাক হয়ে ছিল, বিস্মৃত হয়েছিল। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে আন্দোলন সংগঠিত করেছিল, পচাত্তরে তারা ব্যর্থ হল। তারপর একের পর এক সামরিক সরকার। জিয়াউর রহমানের পর এরশাদ। তখন কিন্তু  ছাত্ররা বুঝে গেল একে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেদিক থেকে বলি আশির দশকের গোড়ায় প্রথম সংগঠিত হল গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। গ্রুপ থিয়েটার সংঘবদ্ধ হওয়ার পর তারা আমাদের দীর্ঘ পথ দেখিয়েছে। এর পর হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আওতায় আমাদের আবৃত্তি সংগঠনগুলো কাজ করে যাচ্ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে আবৃত্তি উজ্জ্বল ছিল কারণ যারা আবৃত্তি করত- যদি সুকান্তের ভাষাই বলি, তাদের গড় বয়স ছিল আঠারো। এই যে আঠারো, উনিশ, কুড়ি- এই বয়স কিন্তু বাধ না মানা বয়স। দেশপ্রেমের কাছে নিজেকে বলি দেওয়ার বয়স। তীক্ষ্ম, তীব্র এক লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাওয়ার বয়স। পুরো নব্বইয়ের  স্বৈারাচার বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এই সমন্বিত আবৃত্তি শিল্পীরা একধরনের প্রাণসঞ্চার তৈরি করল। কারণ অনুজপ্রতীমরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, শক্তি নিয়ে দাড়ায়; তখন অগ্রজ যারা তার যদি প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার শংকায় থাকলেও, সেটা আর থাকে না। অনুজপ্রতীমরা যখন একটা ধাক্কা দেয়, সেই ধাক্কাটা বড় করে হয়। দীর্ঘ দিন যারা পথ চলছে তাদের অফুরন্ত প্রেরণার মধ্যে ঠেলে দেয়। এবং আমি বোধ করি আবৃত্তি শিল্পীরা তা-ই ঘটিয়ে ছিলেন।




জেমস আনজুস: সেই সময়ের কবিতা নিয়ে আপনার কাছে কিছু শুনতে চাই।

হাসান আরিফ: কখনো কখনো আমরা কিন্তু সময়কে ঘিরে, বিষয়কে ঘিরে আমরা কিন্তু কথা শুনতে চাই। তখন কবিরা প্রতিদিনের ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখছেন। যা ঘটছে তাই নিয়ে কবিতা লিখছেন। আর আবৃত্তি শিল্পীরা তা আবৃত্তি করছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ সংগঠিত হয়েছিল আশির দশকে। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের পূর্বেই জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়। সব মিলিয়ে যদি এভাবে বলি, যে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং তার-ই ধারাবাহিকতায় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।  সেই সময় আবৃত্তি শিল্পীরা অসংখ্য কবিতা পেয়েছিল। প্রতিদিন তাজা কবিতা পেয়েছিল। সময়ের সাহসী মানুষদের মধ্যে যাকে সবার উজ্জ্বল বলতে হয়, তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তখন তিনিও যুবক একজন। তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, ‘দাড়াও , নিজেকে প্রশ্ন কর কোন দিকে যাবে? ’  তিনি আমার আমার হাতে তুলে দিয়েছেন ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনা শকুন’ এই যে কবিতায় সরাসরি কথা হচ্ছে, এই কথা যখন মানুষকে বলছি তখন তো আবেদনটা তীব্র হয়। ওই সময় কবিতা তৈরি হচ্ছে হেলাল হাফিজ বলছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাব শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার মিছিলে যারা তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ একই সময় নির্মলেন্দু গুণ মুক্তিযুদ্ধ ও সামরিক শাসন বিরোধী কবিতা লিখছেন। শামসুর রাহমানকে যদি বলি, নূর হোসেনকে আমাদের সামনে পোট্রেট করে দিচ্ছে কবিতার মধ্য দিয়ে।  এবং বলছেন, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো হয়ে যায়। তিনি বলছেন, ধন্য রাজা ধন্য/দেশ ভরা তার সৈন্য। আমি মোহম্মদ রফিকের কথা বলতে পারি। তিনি কবিতার লাবন্য ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বলছেন যে, সব শালা কবি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আবার কবিতায় আন্তর্জাতিকতাবাদ স্থান পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পরে এরকম আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা কিন্তু আমরা খুব একটা দেখতে পাইনা। সেই সময় নেলসন মেন্ডেলাকে নিয়ে সাড়া পৃথিবীতে একটা হৈচৈ চলছিল। আমাদের কবিরা কিন্তু পিছিয়ে থাকে নি। নেলসন মেন্ডেলাকে নিয়ে খেলা হয়েছে কবিতা। সব মিলিয়ে আমরা আবৃত্তি শিল্পীরা বড় মোহনায় এসে দাড়ালাম। মনে হল যেন ইতিহাস প্রতিনিয়ত রচনা করে চলেছেন কবিরা, আর আবৃত্তিশিল্পীদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিদিন সেই ইতিহাস কন্ঠে তুলে মানুষের কাছে বলা।


জেমস আনজুস: সাংস্কৃতি আন্দোলনের সেই যে জায়গাটা, এখন কি স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে?

হাসান আরিফ: আমি খুব স্পষ্ট করে বলি, আমরা কিছু কিছু জায়গায় কিন্তু ভুল করি। আমি যদি বায়ান্ন এর ভাষা আন্দোলনকে ধরি, তাহলে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম  দিচ্ছে। যখন এই জনপদের ব্যাপক মানুষ এই অধিকারে আদায়ের আন্দোলনকে জীবনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। এবং সেই ধারাবাহিকতায় যখন মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে আসে, তখন দেখুন যে সৃজনশীল জায়গাটা একদম পরিষ্কার। সেটা পচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল। তারপর সেটা থমকে যায়। আশির দশকের গোড়ায় আবার সৃজনের জায়গাটা পুনরায় ফিরে আসে। তারপর রাষ্ট্রে সকলের দায় ছিল ঐক্যবদ্ধ ভাবে চলার। সাংস্কৃতিক কর্মীরা তো তাদের লক্ষ্যে চলেছে। আমি তো বলব এরপর বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা হয়েছে, পথ নাটকের চর্চা শুরু হয়েছে, শিশুদের নাটক নিয়েও ঐক্য গড়ে উঠেছে। তার মানে হল সংস্কৃতি কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে কেও কেও বলেছেন, আমরা দলীয় হয়ে গেছি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেখবেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মোর্চায় ছিল। ২২দল, ১৫দল এরকম। তারা একটি অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে ছিল। তাদের লক্ষ্য হল স্বৈরাচারের পতন হবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে। তারপর নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর নব্বইয়ের পর আমি আবার কেন আবার আন্দোলন করলাম?  যে রাজনৈতিক শক্তি স্বৈরাচার পতনে আমার পাশে ছিল তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি।  কারণ তারা গেলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। তারা গণ-আদালতের রায় উপেক্ষা করে চব্বিশজন বরেণ্য ব্যক্তিকে দেশদ্রোহী করেছে। তখন আমি আন্দোলন করেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করেছি। আজ  আমাকে বলা হচ্ছে আমি কোন দলের হয়ে কাজ করছি। আমি কি আসলে কোন দলের হলাম? আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিষয়ে ঢালাও ভাবে বললে হবেনা। পরবর্তীতে দেখেছি, নির্বাচিত সরকারে আমলে বোমা হামলা হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি। তারপর বাংলাভাই এসেছে। তারা ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে। আমার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যখন তারা চলে গেল, সংগত কারণেই তাদের বিরুদ্ধে আমি আমার অবস্থান জানিয়েছি।  এখন আমি বলছি, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়েছি। এটাই কি প্রথম কথা? না। ফেরদৌসী মজুমদার যখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় উচ্চারণ করেছে, তখন কি মনে হয় নি আমরা সংস্কৃতি কর্মীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচারই চাইছি। আমরা যখন রাজাকারের মুখোশটা উন্মোচন করার জন্য দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছি, তাও কি মনে হয় না সংস্কৃতি কর্মীরা কাজ করছে। রাষ্ট্রিয় সমস্যাগুলোর সমাধান করবে রাজনৈতিক দলগুলো। এটি রাজনৈতিক লড়াই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সংস্কৃতি কর্মীরা তো ক্ষমতায় গিয়ে দেশ পরিচালনা করবে না। আমরা আমাদের দাবিগুলো জানাব, আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। আমার জন্মলগ্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার যে সংগ্রাম, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার যে সংগ্রাম;সেই সংগ্রামের কিছু কিছু যখন কোন রাজনৈতিক দল পূরণ করে, তখন আমার মনে হতে পারে আমার দাবিগুলো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মীদের  দাবি যদি কোন দলের কাজে ধ্বনিত হয়েছিল বলেই পাকিস্তানের ২৩ বছরের যে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে ৭ মার্চ বাঙালির জীবনে একজন মাত্র নেতা এভাবে দৃপ্ত সাহসে বক্তৃতা করেছিলেন। যারা বলছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন হচ্ছে না, তারা বিরোধীতা করার জন্য বিরোধীতা করছেন। আমার দাবী কখনো কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সঙ্গে মিলে যায় বা দল বা জোটে সঙ্গে মিলে যায়, তার মানে এই নয় যে আমি সেই দলের কথা বলছি। হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারায় রাখবার জন্য, থাকবার জন্য যে দাবী আমরা ক্রমাগত উত্থাপন করেছি বাংলাদেশে সেই ধারাতেই ফিরে আসতে হবে এবং কখনো কখনো আমাদের সাথে কিছু কিছু রাজনৈতিক শক্তির মিল হয়, কখনো কখনো হয় না। আমি বলতে চাই, সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত হয় নাই। আমি খুব স্পষ্ট ভাবে বলি এখনও আমাদের প্রধান মঞ্চ শহীদ মিনার। আজ যদি ঘোষণা করেন সকল সাংস্কৃতিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেবেন, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক সামাজিক শক্তি থাকবেনা।



জেমস আনজুস: আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা অনেক সময় অর্থবিত্তের কাছে ম্রিয়মান মনে হয়...

হাসান আরিফ: অর্থের কাছে, প্রাচুর্যের কাছে সাংস্কৃতিক প্রবাহ বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ম্লান মনে হয়। কিন্তু সত্যিই কি ম্লান হয়, হয় না? একজন মুকুন্দ দাস কোথায় ছিলেন? একজন লালনের কতগুলো বাড়ি ছিল? একজন রবীন্দ্র নাথ জমিদার থেকে নিঃস্ব হয়েছিলেন। একজন নজরুল ভবঘুরে ছিলেন। একজন আব্বাস উদ্দীন কোথা থেকে এসেছিলেন? একজন আব্দুল আলীম কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন? একজন কুদ্দুস বয়াতি, একজন শাহ আব্দুল করিম এরা কোথায় ছিলেন? শিল্পের শক্তি এত ভয়ংকর! রাষ্ট্র যখন ইতিহাস মুছে দিতে চেয়েছে, তখন শিশু-আবাল-বৃদ্ধবনিতা ইয়াহিয়া খানকে চিনেছে। শুধু একজন শিল্পী একটি মুখমন্ডল এঁেকছিল। আসল ছবি না দেখেও শুধু শিল্পীর আকা ছবি দেখে মানুষ ইয়াহিয়া খানকে চিনে ফেলেছিল। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে ম্লান মনে হয়। এটা আসলে তাৎক্ষণিক এবং একদৃষ্টিতে দেখলে এরকম হয়।  একটি কবিতার একশত বছর উদ্যাপন করা হয়। একজন কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এটি তো শিল্পের ক্ষেত্রেই সম্ভব।  আবার আপনি দেখবেন যে আমাদের দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা  যারা ব্যান্ড সংগীত করে তারা এখন হাসন-লালনের গান করে। এটাই শেকড়মুখী হওয়ারই প্রবণতা।

জেমস আনজুস: সাংস্কৃতিক অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে আবৃত্তি কি রাষ্ট্রিয়ভাবে অবহেলিত মনে করেন?

হাসান আরিফ: বিগত সরকার যে নতুন শিক্ষা নীতি করছে সেখানে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে আবৃত্তি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আমরা সে খবর রাখি না। দীর্ঘদিন পর শিল্পকলা একাডেমী আবৃত্তি বিভাগ করেছে। এটা তো স্বীকৃতিরই বিষয়। আবৃত্তির ক্ষেত্রে টেলিভিশনে গ্রেডেশন হয়েছে। তবে শিল্পকলা একাডেমী জেলা পর্যায়ে যেটা হয়, সেখানে ডিসি সাহেব প্রধান হয়। এখন একজন শিল্পীর সবমহলে পরিচিত হতে হতে ষাট বছর বয়স হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। যাকে আমরা বলি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এখন সেই শিল্পী কি ডিসিকে স্যার বলে তার অধীনে কাজ করা করবে, এটা কি সম্ভব? উপনিবেশিক এই কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। কাঠামো ভেঙে কাঠামো তৈরি করতে হবে। এভাবেই হতে হবে। প্রথমে ব্যক্তিই এগিয়ে যায়, তারপর সমষ্টি তার পেছনে যায়।

জেমস আনজুস: আমাদের দেশে আবৃত্তিশিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে যদি কিছু বলুন।

হাসান আরিফ: শিল্পের লড়াইটা সংখ্যায় নয়, শিল্পের লড়াইটা সৃজনে। সংখ্যা প্রদর্শন করে শিল্পের শক্তি বিবেচনা করা যায় না।১৬ কোটি মানুষের মধ্যে যাদের  গান বা আবৃত্তি শোনবার ব্যবস্থা আছে, তাদের মধ্যে কতজন আবৃত্তি শোনে তার ওপর নির্ভর করবে আবৃত্তির বিস্তৃতি কতটুকু হল। গণমাধ্যম গুলো কতটা বাধ্য হচ্ছে আবৃত্তি প্রচার না হলে চলছে না, তার ওপর নির্ভর করে আবৃত্তি কতটুকু বিস্তৃতি হচ্ছে। ব্যাপক গণমাধ্যমের প্রসার যখন হচ্ছে , তখন তারা নিবেদিত হলে এমন শিল্পী বেড়িয়ে আসবে যিনি একাই আবৃত্তির দিগন্তকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে। অন্য রকমভাবে এর আবেদন তৈরি করতে পারবে। মানুষের মনে আবৃত্তির স্থান করে দিতে পাবেন।

আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুল ইসলামের সাক্ষাৎকার- An interview of Mahidul Islam, a famous recitation artist of BD.

আবৃত্তি কণ্ঠে ধারণ করতে চাই শেষ দিন পর্যন্ত : মাহিদুল





মাহিদুল ইসলাম। একজন স্বনামধন্য আবৃত্তি শিল্পী। জন্ম  ১৯৬৯ সালের ২৬ আগস্ট বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে। বাবা আব্দুল কুদ্দুস এবং মা লতিফা বেগম। বাংলাদেশে আবৃত্তিশিল্প প্রসারে তিনি কাজ করছেন নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন থেকে। এ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি আবৃত্তির অ্যালবাম বেরিয়েছে তার। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও  আবৃত্তি করে এসেছেন গুণী এই শিল্পী। পেশা মুদ্রণ ব্যবসা হলেও নেশা তার আবৃত্তি। সম্প্রতি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জেমস আনজুস।


জেমস আনজুস : আবৃত্তির প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলো কীভাবে?

মাহিদুল ইসলাম : ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকারবিরোধী যে আন্দোলন চলেছিল তখনই আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। সে সময় মানুষের ভেতরের আকাঙ্ক্ষা ছিল সামরিক সরকার হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমি তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন কর্মী। আবৃত্তি করতে করতে যখন দেখলাম, মানুষকে আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করতে পারছি, তখনই ভেতরে এক ধরনের জাগরণ তৈরি হয়। আসলে মানুষের ভালোবাসাই সে সময় আমাকে আবৃত্তি করতে সাহসী করে তোলে।

জেমস আনজুস: তখন থেকেই কি আবৃত্তির প্রতি পুরোপুরি নিবেদিত হলেন?

তখন থেকেই আবৃত্তি শেখা, আবৃত্তিশিল্পের প্রতি আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে আমার। আবৃত্তি আমার প্রাত্যহিক অবশ্যকরণীয় হয়ে ওঠে।
অতীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে আবৃত্তি শিল্পীরা একটা অবস্থান নিয়ে রাজপথে নামতেন। এখন আনন্দোলনের রূপটা কেমন? 

গণমানুষের দাবিদাওয়া ও আকাঙ্ঙ্ক্ষা যখন যৌক্তিক হয় এবং বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়, তখন অবশ্যই সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আবৃত্তি শিল্পীরাও রাজপথে নামেন। কোনো রাজনীতি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আবৃত্তি কখনোই একাত্মতা প্রকাশ করেনি, করবেও না। তবে যে কবিতায় সমাজচিত্র বা মানবিকতার বিকাশ থাকে, আবৃত্তিশিল্পীরা সে ধরনের কবিতাই আবৃত্তিতে রূপান্তর করে। একজন মানুষকে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন করে তোলার দায়বদ্ধতা আবৃত্তি শিল্পীদের সব সময় ছিল, আছে এবং থাকবে। একজন আবৃত্তিকার সমাজ বা রাষ্ট্র পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন না। তিনি শুধু মানুষকে সচেতন করেন মাত্র।

জেমস আনজুস: বাংলাদেশে আবৃত্তিচর্চার পটভূমি নিয়ে খানিকটা বলবেন?

দেশ স্বাধীনের আগে বিছিন্নভাবে নাটক বা আবৃত্তি চর্চা হতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতে গণসংগীত ও কথিকা পাঠের পাশাপাশি আবৃত্তি করা হতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যখন মঞ্চ নাটক বিকশিত হয়, তখনো সেই নাট্যশিল্পীরাই সমান্তরালে আবৃত্তি করতেন এবং যা ছিল বিচিত্রা অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ। আবৃত্তি তখনো আলাদা শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আশির দশকে আবৃত্তিচর্চার নিজস্ব ধারা তৈরি হলো। আলাদা সংগঠন হলো। নব্বইয়ের সামরিক সরকার পতনেও আবৃত্তিশিল্পীদের ভূমিকা চিহ্নিত করা গেল আলাদা করে। তখনই মূলত আবৃত্তি সাংগঠনিক রূপ নেয়। এখন আবৃত্তি স্বয়ম্ভু একটি শিল্প এবং সাংগঠনিক চর্চার জায়গা।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির ক্ষেত্রে যেন কিছু কবিতারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আবৃত্তি করার মতো নতুন কবিতা কি লেখা হচ্ছে না?

বাঙালির জীবনধারার সঙ্গে কবিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যত দিন বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি থাকবে, তত দিন বাংলা কবিতা রচিত হবে। আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করবেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সব শিল্পের আঙ্গিক বা রূপ বদল হবে। বর্তমানে উত্তরাধুনিক কবিতার যুগ চলছে। এখনকার কবিরা যে আঙ্গিকে কবিতা লিখছেন, আবৃত্তিশিল্পীরা হয়তো সেভাবে কণ্ঠে ধারণ করছেন না। তবে ভালো কবিতা অবশ্যই রচিত হচ্ছে। বাংলা ভাষায় অতীতে যে কবিতা রচিত হয়েছে, আবৃত্তিশিল্পীরা সেই কবিতা এখনো আবৃত্তি করে শেষ করতে পারেননি। এখন যেসব কবিতা রচিত হচ্ছে কিছুদিন পর হয়তো সেগুলো আবৃত্তি করা হবে। তবে সেগুলো যে একেবারে আবৃত্তি হচ্ছে না, তা নয়। আমরা সমসাময়িকদের কবিতাও আবৃত্তি করছি।

জেমস আনজুস: অতীতে আবৃত্তির যে আঙ্গিক ছিল আর বর্তমানে যে আঙ্গিক, তাতে কি কোনো পালাবদল হয়েছে?

আবৃত্তির আঙ্গিকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সত্তর থেকে আশির দশকের আবৃত্তির আঙ্গিক অনেকটাই বদলে গেছে। এখনকার আবৃত্তি অনেক বেশি সংবেদনশীল। সাধারণ মানুষের কাছে এখনকার আবৃত্তি অনেক বোধগম্য। কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা এখন সবাই খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। আমার কাছে মনে হয়, এখন আবৃত্তির যে ফর্মটা প্রচলিত, এটা দীর্ঘায়িত হবে। আমার বিশ্বাস, তা সর্বজনীনও হবে ভবিষ্যতে।



জেমস আনজুস: সব কবিতাই কি আবৃত্তি করা যায়?

না। সব কবিতা আবৃত্তি করা যায় না। ধরুন, পাখি যে গান গায়, খুব সুন্দর করে গায়। তবু কেউ শুনল কেউ শুনল না- পাখি কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু আবৃত্তিশিল্পী যদি আবৃত্তি করেন, আর তা কেউ যদি না  শোনেন তা হবে পাগলের প্রলাপ। যে কবিতা মানুষকে আকৃষ্ট করে, যে কবিতায় মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটে, তাকে আন্দোলিত করে সেটিই আবৃত্তি করেন একজন আবৃত্তিশিল্পী। কবিতার বক্তব্য যদি দুর্বল হয়, কবিতায় যদি বার্তা, দিকনির্দেশনা, সমাজসচেতনতা না থাকে, তাহলে তো সে কবিতার আবৃত্তিই নিরর্থক। তা  আবৃত্তি করলে মানুষ কেন শুনবে?

জেমস আনজুস: আপনার প্রিয় কবি কে? কার কবিতা আবৃত্তি করতে ভালো লাগে?

যেকোনো ভালো কবিতাই ভালো লাগে আমার। যেটা আবৃত্তি করলে বেশিরভাগ শ্রোতাকে আকৃষ্ট করা যায়, সে ধরনের কবিতাই আমি আবৃত্তি করি। কারণ, আমার সময়ের এবং শ্রমসাধনার একটা তুল্যমূল্য আমি দাঁড় করাতে চাই। বিষয়ভিত্তিক বললে বলব, যে কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধ রয়েছে, যে কবিতা মানুষের চেতনায় একটুখানি হলেও আঘাত করে, সে কবিতাই আমি বেছে নিই।

জেমস আনজুস: আমাদের দেশে আবৃত্তির বর্তমান অবস্থা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?  

বর্তমানে দেশে সার্বিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অস্থিরতা রয়েছে। সে রকম একটি দেশে অন্যান্য যেসব বিকশিত শিল্প রয়েছে, তার পাশাপাশি আবৃত্তিশিল্প বেশ গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা এবং এর বিকাশ চলছে। আস্তে আস্তে পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে এ শিল্পের। শ্রোতা বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যায়নও। আমি মনে করি, সঠিক পথেই রয়েছে বাংলাদেশের আবৃত্তি। আর বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এভাবে আবৃত্তি চর্চা হয় না।

জেমস আনজুস: শিল্প হিসেবে আবৃত্তির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেন?

বাংলাদেশেই হবে একটা নতুন যুগের সূচনা, যেখানে আবৃত্তি একটা পেশাদার শিল্প হিসেবে দাঁড়াবে। তবে একটু কঠিন হবে। কারণ এর ক্যানভাসটা বেশি বিস্তৃত না। দর্শক-শ্রোতা অনেক বেশি বিস্তৃত না। এর পৃষ্ঠপোষকতাও যথেষ্ট না। সে কারণেই আবৃত্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে নেওয়া একটু কঠিনই হবে। তবু আমি মনে করি, এ দেশে আবৃত্তিশিল্প একদিন পেশা হিসেবে দাঁড়াবে, যদি তরুণ মেধাবী প্রজন্ম আরো বেশি সাহসী হয়।

জেমস আনজুস: আবৃত্তিশিল্পে সাংগঠনিক চর্চার অবদান খুবই উজ্জ্বল, বর্তমানে কেমন চলছে সংগঠনগুলো?

সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চায় আবৃত্তিকর্মীরা অনেক বেশি সংগঠিত, অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। তারা লাভ-লোভ-স্বার্থ-মোহমুক্ত। তারা শিল্পের প্রতি নিবেদিত হয়েই কেবল বারবার সংগঠিত হন।

জেমস আনজুস: সম্প্রতি  শিল্পকলা একাডেমীতে নতুন বিভাগ হিসেবে আবৃত্তি যুক্ত হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

আবৃত্তিকর্মীরা এত দিন নিজেদের গড়া বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আবৃত্তি করে চলছিলেন। এখন হয়তো আবৃত্তির জন্য সরকারি একটা ভীত স্থাপিত হলো। এটা সরকারের স্বীকৃতি বলা যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরো বাড়বে। তবে আমি মনে করি, আবৃত্তিশিল্পের বিকাশ এর সাংগঠনিক চর্চার ওপরই নির্ভর করবে।

জেমস আনজুস:আবৃত্তির জন্য নিজের স্বীকৃতি বা সম্মাননা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...

বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময় নানা রকম স্মারক বা স্বীকৃতি দিয়েছে আমাকে। তবে এসব নিয়ে আমি খুব একটা উচ্ছ্বসিত বা আন্দোলিত নই। ভালোবাসার টানেই আবৃত্তি করি, আবৃত্তি কণ্ঠে ধারণ করতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মুস্তাফা’র সাক্ষাৎকার- An interview of Famous Recitation Artist Shimul Mustafa

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে, মানসিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো উচিত : শিমুল মুস্তাফা



দেশের একজন জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মোস্তফা। ১৭ অক্টোবর ঢাকায় তার জন্ম। তার বাবা  প্রয়াত খান মোহম্মদ গোলাম মোস্তফা এবং মা আফরোজ মোস্তফা। আবৃত্তি তার পেশা নয়, নেশা। ঘেরতর নেশা। আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। কন্ঠে আওয়াজ তোলেন। তার ভয়হীন কন্ঠ আজও ভয়হীন। শিল্প তার কাছে প্রার্থনা, সেটি  শিল্পের যে মাধ্যমই হোক না কেন। একজন দূরন্ত, দুর্নিবার এবং চির আপোষহীন মানুষ শিমুল মোস্তফা।  তার এই সাক্ষাৎকারটি শুধুমাত্র আবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিল্পের বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যম এবং শিল্পীর নৈতিক ও মানসিক মূল্যবোধের দার্শনিক অভিপ্রায় একই বৃত্তে উঠে এসেছে। তিনি এপর্যন্ত প্রায় ৪০টির মত আবৃত্তি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  জেমস আনজুস।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির প্রতি ভাল লাগাটা  কিভাবে তৈরি হল?

শিমুল মুস্তাফা : এটা তো কোন আয়োজন করে হয় না।  আস্তে আস্তে বিষয়টি ঘটে যায়। আমার পারিবারিক বন্ধনই ছিল শিল্পমনা। আমার মা বাবা দুজনেই চারুকলার ছিলেন। তাই পরিবারেই একটি শিল্পের আবহ ছিল । 

জেমস আনজুস: কবিতা ও আবৃত্তি- শিল্পের দুটি মাধ্যমকে কিভাবে বিবেচনা করবেন।

শিমুল মুস্তাফা : কবিতা এবং আবৃত্তির সম্পর্ক অনেকটা  মা-মাসির মত। আমি এটাই বলি কবিতা জন্ম দেন কবি, তিনি মা। আর কিন্তু আবৃত্তিকাররা কবিতার মাসি অন্তত। জনক না হলেও স্নেহের জায়গাটা, প্রেমের জায়গাটা, আন্তরিকতার জায়গাটা, লালনের জায়গাটা একটা আবৃত্তিকারের কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। কবিতা হচ্ছে বোধের জায়গাটা তৈরি, মানুষকে উপলব্ধি করার জায়গাটা। আমি কবিতাকে এভাবেই ধারণ করি। কবিতা ভালবেসেই পড়ি। আমি যা পড়ি তা বিশ্বাস করি। যেমন ভাল লাগল একটি কবিতা , কিন্তু আমার আদর্শের সাথে মেলেনা , আমি সে কবিতা পড়ি না। আবৃত্তি কন্ঠের শিল্প নয়, মস্তিষ্কের শিল্প। কন্ঠ হচ্ছে একটি সাউন্ড বক্সের মত। মস্তিষ্ক যদি পরিশিলীত না হয়, সাউন্ড বক্স নিজে নিজে আর কি রকম বাজতে পারে? আমার মস্তিষ্কে যে বোধ এবং  দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে, সেটাই আমি কন্ঠ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি।


জেমস আনজুস: বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার পটভূমি নিয়ে যদি কিছু বলেন..

শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি চর্চার ব্যাপারটা আসলে স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়। কিন্তু আমি বলব আবৃত্তির মূল বহিঃপ্রকাশ গোলাম মোস্তফা, ইকবাল বাহার চৌধুরী, হাসান ইমাম এদের হাত ধরে বাংলাদেশে  শুরু হয়। এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে  আবৃত্তি সেই অর্থে ভূমিকা না রাখলেও মধ্য সত্তরের দিকে কাজী আরিফ, জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় সাথে প্রবীন যে আবৃত্তি শিল্পীদের কথা বললাম এরা মিলে আবার আবৃত্তি চর্চা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সত্তরের দশকের রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটের কারণে শিল্প চর্চায়ও একটি ধ্বস নেমে আসে। কারণ আমরা দেখেছি দেশের ক্রান্তিকালে শিল্পীরা তাদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী করে ফেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য পচাত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত শিল্পকলার প্রত্যেকটি মাধ্যম সেই ভাবে জেগে  উঠতে পারেনি। অনেকটাই আস্থাহীন, হতাশায় পড়ে গিয়েছিল শিল্পীরা। আমাদের বিগত দু’শত বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আমরা যেভাবে রুখে দাড়িয়েছি, কিন্তু এই পাঁচ বছর আমাদের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন মিডিয়া যে ভাবে কাজ করছে, তখন তো এত মিডিয়া ছিল না। আর যেগুলো ছিল সেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করেছে। ফলে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল।





জেমস আনজুস: নব্বইয়ের গন আন্দোলনে আবৃত্তির তো বিরাট ভূমিকা ছিল...

শিমুল মুস্তাফা :  একাশির পর আবার নতুন করে প্রেরণা, অনেক সাহস, নতুন উদ্দিপনা, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে শিল্পকলায় আমাদের অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এবংএরই ধারাবাহিকতায় খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে আমাদের থিয়েটার এবং সাথে সাথে আবৃত্তি। তখন সংগীত যতটা না সক্রিয় হয়ে ওঠে, থিয়েটার এবং আবৃত্তি অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। সেই সময় পথনাটক কর্মীরা, মঞ্চ নাটক কর্মীরা রাজপথে ছিলে, তবে নেতৃত্বে ছিল  আবৃত্তি শিল্পীরা। আবৃত্তিতে সে সময় যে পরিবর্তন আসে, তা হল আমাদেরকে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী যে শৃঙ্খলিত করে রাখার পায়তারা ছিল তার বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলি। এরই সাথে সাথে কবিরাও সোচ্চার হয়ে উঠে। স্বৈরাচারি সরকার হটাতে তারাও উদগ্রিব হয়ে ওঠে। তারই ফলশ্রুতিতে মধ্য আশিতে তৈরি হয় কবিতা পরিষদ। এবং শুরুতেই তখন বলা হয়েছিল  যে,  শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এই কথা প্রথম কবিরাই প্রকাশ করে। তার বছর দুয়ের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় আবৃত্তি উৎসব, গঠিত হয় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এসময় অনেক কবি এবং আবৃত্তিকারকে জেল জুলুম খাটতে হয়। হুলিয়া চলে আসে। অনেক কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এসময় কবিতা এবং আবৃত্তি একই সাথে কাজ করেছে। নব্বইয়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে প্রেমের কবিতাও প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গেল এক সময়। আমরা খুব রোমান্টিক কবিতাকেও মানুষের দাবিদাওয়া হিসেবেই তুলে ধরলাম। তখন নিষিদ্ধ ছিল আমাদের কবিতা পড়া। আমরা কবিতা পড়তে গেলেই পুলিশ ধাওয়া করতো। । আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হত। সেই প্রেক্ষাপটেই আমার জন্ম। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতেই আবৃত্তি করা, আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই।

জেমস আনজুস: নব্বইয়ের আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসক এরশাদ বিদায় হল।

শিমুল মুস্তাফা : তবে নব্বইয়ের পর আমার মনে হয়েছে একাত্তরে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা স্বপ্নই রয়ে গেছে। অনেকে বলে একানব্বইয়ে আমাদের দেশে গনতন্ত্র এসেছে, আমার কাছে তা গনতন্ত্র মনে হয় না। গনতন্ত্র সংজ্ঞাই আমাদের দেশের মানুষ জানে না। খুবই কম সময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। এত অল্প সময়ে আমরা আসলে বুঝতে পারিনি, এই বিজয় যদি নয় বছরে হত তাহলে এর মূল্য আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশন যুদ্ধ চললে আমরা এর মূল্যটা বুঝতাম।  বায়ান্ন, একাত্তর বা নব্বইয়ে সমর্থন দিয়েছিল অনেকে, কিন্তু বিসর্জন দেয়নি। স্বৈরশাসকের সময়ে আমাদের মত অনেক শিল্পী রাজাকারের ভূমিকা পালন করেছে। আসলে অতীত আমরা খুব সহজে ভুলে যেতে পারি,  নাহলে হয়ত আমরা বাঁচতে পারতাম না। একদিক দিয়ে এটা যেমন ভাল, আবার এটাই হচ্ছে সবচে খারাপ দিক। 

একানব্বইয়ের পরে আবৃত্তি আস্তে আস্তে সংগঠিত হল। প্রেমের কবিতা যেভাবে প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে তা আবার প্রেমের কবিতা হয়ে উঠল। প্রতিবাদের কবিতাগুলো আমরা ধীরে ধীরে পড়তে ভুলে গেলাম। আমরা আমাদের ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদ- বাহান্ন, একাত্তর, নব্বই এই আন্দোলন করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নব্বইয়ের পর যখন আমরা আলোর দিশা দেখলাম, তখন আমরা হুরমুর করে সেই দিশার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। আমাদের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য আমরা নেমে পড়লাম। অনেকে ভেবেছে আমাদের আর এভাবে চললে হবে না। তখন অনেকেই আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল হয়ে উঠল। এর ফলে আমরা শিল্পীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করতে শুরু করল , আরেকটি  আমরা আগের মতই রয়ে গেলাম।
শিমুল মুস্তাফা’র সাথে এই ব্লগের লেখক


জেমস আনজুস: শিল্পীদের কি রাজনৈতিক পরিচয় থাকাটা জরুরি?

শিমুল মুস্তাফা : শিল্পীর রাজনৈতিক আদর্শ থাকাটা জরুরি, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের ভেতর অবস্থান করে কাজ করাটা আমি সমর্থন করি না। আমাকে যদি বলা হয় হাতের দশটা আঙল কেটে ফেলা হবে, আমি কিন্তু পায়ের আঙল দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই আমার অবস্থান জানাব। কিন্তু  টেলিভিশন পর্দার সামনে অনেক দেশ প্রেমিক দেখা যায়, তারা কিন্তু ঠিকই দৌড়ে পালাবে। কে সরকার হল এটা আমি দেখি না , আমি দেখি কে দেশকে ভালবাসার কথা বলে, কে আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে। আমার জীবনে আমি কোন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে কবিতা পড়িনি। আমার পয়ত্রিশ বছর আবৃত্তি জীবনে আমি কোন দিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমন্ত্রন পাইনি। তাতে কি হয়েছে?

জেমস আনজুস: আমাদের সংস্কৃতি চর্চার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শিমুল মুস্তাফা : আমরা পাতা বাহার দিয়ে বাগান ভরে ফেলছি কিন্তু গোলাপ ফোটাতে পারছি না। আমি একটি জিনিস মনে করি যে একটি জিনিসের বিন্দু যদি সরে যায়, বৃত্তও সরে যায়। আমাদের বিন্দু গুলো ক্রমশ সরে যাচ্ছে। আমাদের শেকড় থেকে বিন্দু সরে যাচ্ছে। আমাকে অনেকে বলে আপনি এখানে যান না কেন, ওখানে যান না কেন? আসলে শিল্পীকে লোক দেখানোর জন্য শিল্প চর্চা করলে হবে না। টেলিভিশনের পর্দা বা বিশেষ জায়গার প্রয়োজন হয়না শিল্পী হওয়া জন্য। একজন বলেছেন, তুমি যদি সুরেলা কন্ঠে গান গাও তাহলে পৃথিবীর যে প্রান্তে বসেই গাও না কেন, কেও না কেও তা ঠিকই শুনছে। আমি যদি অজপাড়াগায়ে বসেও যদি দেশের জন্য কাজ করি, কোন শিল্পের জন্য কাজ করি  কোন একদিন সেখান থেকেই আলো জ্বলে উঠবে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, আপনাকে আগের মত দেখিনা কেন? আমি একটিই উত্তর দেই, আমি আগের জায়গাতেই আছি, বরং আপনারাই আগের জায়গা থেকে সরে গিয়েছেন। তাই আমাকে দেখতে পান না।


আর মূল্যবোধের জায়গাটায় আমরা খুবই দূর্বল। এখনকার সরকার ব্যবস্থায় আমার প্রতিবাদের জায়গা হল, আমরা খুব অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি, এতে করে আমাদের মূল্যবোধের জায়গাটা খুব কমে যাচ্ছে।  দশ-পনের বছর ধরে যা দেখছি, এ প্রজন্ম কিন্তু অনেক মেধাসম্পন্ন, কিন্তু এ প্রজন্মকে নৈতিক জায়গাটা শেখানো হচ্ছে না। এজন্য আমি বলি, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে, মানসিক প্রবৃদ্ধিটা বাড়ানো উচিত। আমার কষ্ট করতে আপত্তি নেই । একবেলা কম খাব, কিন্তু আমাদের নৈতিক বোধটা যদি বাড়তো আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসার জায়গাটা যদি কমতো তবে খুব ভাল হত। 


জেমস আনজুস: শুধুমাত্র ঢাকা শহরের কথাই যদি বলি, শিল্পচর্চা বা শিল্প প্রদর্শনের তেমন একটা জায়গা কিন্তু নেই।

শিমুল মুস্তাফা : বাংলাদেশ এমন একটি দেশ- ষড় ঋতুর দেশ, শিল্পের দেশ। আমাদের মন এমনিতেই শিল্পের দিকে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্পচর্চা করার মত জায়গা তেমন একটা নেই। ঢাকার মত একটি সিটিতে কয়টি মঞ্চ আছে? জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী  ছাড়া তেমন ভাল কোন অডিটরিয়াম নেই। জাদুঘর অডিটরিয়মের যে ভাড়া তা সবার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। উত্তরার মত জায়গাতে অনুষ্ঠান করার মত কোন অডিটরিয়াম নেই । মিরপুরে নেই। যাত্রাবাড়িতে নেই। এখানকার মানুষগুলো কোথায় অনুষ্ঠান করবে? কোটি মানুষের ঢাকা শহরে শিল্পকলা আর জাদুঘর অডিটরিয়াম দিয়ে কি সব শিল্পমন তুষ্ট করা যাবে? এই সমস্যা গুলো সমাধান করা যায় খুব সহজে। শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রয়োজন। শুধু ইচ্ছা।  রাষ্ট্রের পাশাপাশি এদেশের শিল্পপতিরাও এদিকে নজর দেন না। 




জেমস মুস্তাফা: আবৃত্তির সংগঠন গুলো যেভাবে কাজ করছে,  আবৃত্তি শিল্পী কি আমরা সেভাবে পাচ্ছি ?

শিমুল মোস্তফা : ওটার জন্য আমরা কিছু দায়ী, আর আমাদের মন মানসিকতা অনেকখানি দায়ী। একটি জাতীর পরিচয় বহন করে তার শিল্পকলা। বাংলাদেশকে আমরা চিনব এদেশের শিল্পকলা দিয়ে। ভারতে যে বাণিজ্যিক শিল্পকলা গুলো হচ্ছে- চলচ্চিত্রে, গানে আমরা কিন্তু ওটা দ্বারা মোহিত হচ্ছি। কিন্তু ভারতে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে একজন বানিজ্যিক শিল্পীর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হয়। ভারতে একটি গানের লিরিক জাবেদ আকতার লিখলে পাঁচ লক্ষ রুপিস পায়। বাংলাদেশে একটি গানের লিরিক লিখলে পাঁচশত টাকা পায়। আমাদের দেশে একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তার চেয়ে দশগুন বেশি মূল্যায়ন করা হয় আধুনিক একজন ড্যান্সারকে। আজকে আমি কবিতা লিখলে আমাকে যদি দুইশত টাকা সম্মানী দেওয়া হয়, আর কবিতার অর্ধেক শ্রম দিয়ে আমি যদি একটি টেলি নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করি আমাকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ফলে এ প্রজন্ম কবিতা লিখবে না নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখবে। আমি কবিতা পড়লে আমাকে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে বিদায় করা হয়, আর একজন ড্যান্সার মঞ্চে উঠলে তাকে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোও তাই। আমাদেরকে এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন করা হয়, আর একজন সংগীত শিল্পী আসলে  ষাট-সত্তর হাজার টাকা।  আমাদের শিল্পবোধের কারনেই হয়তো ভাল আবৃত্তি শিল্পী বা একজন ভাল কবি আমরা পাই না। প্রজ্ঞা লাবনী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী।  একটি টিভি চ্যানেলে তিন ঘন্টা সরাসরি অনুষ্ঠান করার পর তার হাতে একহাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, শিল্পীকে টাকা না দাও, কিন্তু অসম্মান কোরো না। সেই চ্যানেলে পাঁচ বছর ধরে আমাকে ডাকে না।  আমি প্রতিবাদ করব, আরেক জন করবে, তৃতীয়জন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে টেলিভিশনে আবৃত্তি করবে। কারণ আমাদের লোভ লালসাটা অনেক বেশি। কেও কেও অর্থের জন্য লালসা দেখায়, কেও কেও অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়। এদের দলে তো আমরা নই। 


জেমস আনজুস: রাষ্ট্রিয় ভাবে আবৃত্তির মূল্যায়ন কি সেভাবে হচ্ছে, গান নাচ বা চলচ্চিত্র শিল্পের বিবেচনায়?

শিমুল মুস্তাফা : আমরা যাদের দ্বারা ভাষা পেয়েছি- শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি কয়টা ফুল দিয়ে সব দায় মিটিয়ে দেই। বিশ্বের বুকে যারা এদেশের জন্য সম্মান এনে দিয়েছে তাদেরকেই বা কতটুকু দিয়েছি?  দস্যু বনহুরের লেখক রুমেনা আরফাস, যার বই ট্রাকে করে করে বিক্রি হয়েছে। সেই নারী রাষ্ট্রিয় সম্মান তো দূরের কথা, ফুল দিয়েও তাকে সম্মান জানানো হয় নি।  মরে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমরা হঠাৎ করে মনে করলাম শাহ আব্দুল করিমের কথা। তারপর তাকে নিয়ে কাজ কাজ শুরু করলাম। বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে একটি জন্ম বাষির্কী পালক করা হয় না। তার নামে একটি প্রতিষ্ঠান কেন, রাস্তাও হয়নি। অথচ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জামানত বাতিল হয়েছিল এমন একজনের নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া। তাকে আমরা নূন্যতম মূল্যায়ন করতে পারিনি।  আবৃত্তির ক্ষেত্রে আশা করাটা তাই মানায় না। 


জেমস আনজুস: পেশা হিসেবে আবৃত্তি শিল্পের ভবিষ্যৎ কি?

শিমুল মুস্তাফা : আবৃত্তি পেশা হিসেবে দাড়াবে- এমটা আমি চাইনা।  শিল্প যখন পেশা হয়ে যায় তখন শিল্পত্ব হানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে একজন ক্লাসিক্যাল শিল্প আছে পন্ডিত গোলাম মোস্তফা। সংগীতটা তার প্রার্থনার মত। টেলিভিশনের সামনে আসাটা তার জন্য জরুরি না। প্রার্থনাটা তার জন্য জরুরি। লালন যখন গান করেছেন, তিনি কিন্তু এই চিন্তা করে গান করেন নি যে পরবর্তীতে আরো অনেকে তার গান গাইবে। তিনি তার আত্ম তৃপ্তির জন্য গেয়েছেন। সেরকম আবৃত্তি আসলে আত্মতৃপ্তির জন্যই করা উচিত। 

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার - An interview of Bhaswar Banerjee, a famous recitation artist of Bangladesh

আবৃত্তির রাষ্ট্রিয় সমাদর এখনো হয়নি: 
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়



বাংলাদেশের একজন প্রাজ্ঞ আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৫২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুলনা শহরে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা প্রয়াত লোহিত কান্তি বন্দোপাধ্যায়। মা প্রয়াত দেবী বন্দোপাধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা নিয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর নাটকের ওপর ডক্টরেট করেছেন রবীন্দ্রভারতী থেকে। আবৃত্তি শিল্পের একনিষ্ঠ মানুষটি হাতেগোনা চার থেকে পাঁচটি আবৃত্তির একক অ্যালবাম করেছেন। বর্তমানে স্ট্যামফোর্ট ইউনিভার্সিটিতে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। এই নিবেদিত প্রাণ আবৃত্তিশিল্পীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেন জেমস আনজুস। সেই আলাপচারিতার সুত্র ধরেই এই বিশেষ সাক্ষাতকার।

জেমস আনজুস : আবৃত্তির প্রতি ভাললাগা তৈরি হল কিভাবে?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : বাবা ঘরে আবৃত্তি করতেন। তিনি নিজে অভিনয় করতেন। নাট্য নির্দেশক ছিলেন। কলকাতায় যে অ্যামেচার থিয়েটার গ্রুপ ছিল সেখানে অভিনয় করতেন। কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর আমাদের খুলনায় তিনি অভিনয় করতেন। নাটক নির্দেশনা দিতেন। সবাইকে সংগঠিত করে নাটক শেখাতেন। তার এই ধারার কিছুটা ছাপ বা প্রভাব আমার মধ্যে কাজ করে। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনতে শুনতে নিজেও কিছু আবৃত্তি করতাম। ছোটবেলায় স্কুলে সমাপনী অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতাম। ঘরোয়া অনুষ্ঠান, পাড়ার অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করতাম। কেমন করতাম জানি না, তবে লোকজন উৎসাহিত করতেন। তারপর আকাশবাণী কলকাতায় আবৃত্তি শুনতাম; সৌম মিত্র, দেব দুলাল, পার্থ ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ, গৌরী মজুমদার, কাজী সব্যসাচী প্রমুখের আবৃত্তি শুনতাম। তাদের আবৃত্তি শুনে সাংঘাতিক আপ্লুত হতাম।  ঢাকায়ও তখন আবৃত্তি হত। তবে খুলনা থেকে ঢাকার বেতারের চেয়ে কলকাতার বেতার পরিষ্কার শোনা যেত। এটা ষাটের দশকের কথা। তখন ঢাকায় টেলিভিশন চালু হলেও খুলনায় আমরা দেখতে পেতাম না। সঙ্গতকারণেই ঢাকার আবৃত্তি সম্পর্কে জানা ছিল না। আসলে এই শিল্পের প্রতি আমার ভালবাসা তৈরি হয়েছে- প্রথমত আমার বাবার কাছ থেকে এবং আকাশবাণী কলকাতার আবৃত্তি শুনে।
জেমস আনজুস : আবৃত্তি জন্য পুরোপুরি নিবেদিত হলেন কখন থেকে?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : কতটুকু নিবেদিত হতে পেরেছি, এটা তো নিজে বলতে পারি না। নিবেদিত বিষয়টা অনেক বড়। তবে ভালোলাগার একটা বিষয় ঘটেছিল। দেখতাম প্রশংসা পাচ্ছি। আবৃত্তির একটা চাহিদা আছে। আর ভাল আবৃত্তি মানুষ শুনতে চায়। অন্যদের ভালো লাগা, আর প্যাশন থেকেই আবৃত্তি করা। ছোটবেলা থেকে করছি। এর মাঝে যদি নিবেদনের বিষয়টি ঘটে থাকে, তা আমি জানি না। কবিতার শব্দ, কবিতার আবেগ, কবিতার চিত্রকল্প, রূপকল্প- এগুলো ভীষণভাবে টানে এবং এটাকে প্রকাশ করার জন্য ভিতর থেকে প্রচন্ড তাগিদ অনুভব করি। তাই আবৃত্তি করি।

জেমস আনজুস : স্কুল জীবনে একরকম ছিল, তারপর যখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন, তখন?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক পেতে থাকলাম, বুঝতে পারলাম এটা সবাই পছন্দ করছে। তখন বুঝলাম খুব সর্তক হয়ে, শিখে, মহড়া দিয়ে, চর্চা করে কত রকমে কবিতা উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। কলেজ পর্যায় থেকেই এটা শুরু হয়েছে। বুঝে, শুনে করা। অর্থ বুঝে করা, আবেগ দেওয়া এই সব। সেটিও স্বাধীনতার আগে। তখন খুলনা বেতারকেন্দ্র শুরু হল। ১৯৭০ সাল থেকে আমি সেখানে পাঁচ-ছয় বছর কাজ করি। সংবাদলেখা, অনুবাদ ও পড়া, আবৃত্তিসহ নানা অডিশন দিয়ে ওখানে কাজের সুযোগ পেলাম। সব শিল্পীই প্রথম দিকে অনুকরণ করে। অনুকরণ না করলে শেখাও যায় না। চর্চা করতে করতে একটা নিজস্বতা তৈরি হয়।

জেমস আনজুস : আপনি তো আবৃত্তির পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করতেন...
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় :  স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। তার আগে বেতারে সাংবাদিকতা করেছি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একটা পত্রিকায় নিউজ এডিটর হিসেবে কাজ করি। সেটাও খুলনাতে। সেখানে কাজ করতে করতে ঢাকার দৈনিক বঙ্গবার্তা পত্রিকার খুলনা প্রতিনিধি হই। এই কাজটিও খুব আগ্রহ নিয়ে করতে থাকি। আমার অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টগুলো প্রথম পাতার ব্যানার হেড হিসেবে আসতো। তখন মনে হল, হ্যা আমি তো পারি! এতেই সাংবাদিকতায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম। বাড়ি থেকে বলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা পড়ার জন্য। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে সাংবাদিকতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এদিকে আমার ভেতরে আবৃত্তি আছে, নাটক আছে। ঢাকা বেতার, পত্রপত্রিকায় লেখা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ করতে শুরু করলাম। এর মাঝে থিয়েটারও করতাম। ভারত সরকারের বৃত্তি দিয়ে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে নাটক দিয়ে পড়তে চলে গেলাম দিল্লিতে। তিন বছরের কোর্স শেষ করে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স পড়াও শেষ করলাম। দিল্লি থেকে ফিরে কলকাতায় নাটক নিয়ে এক বছর গবেষণা করলাম। সেখান নাটক করতাম, শেখাতাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কর্মশালা করতাম। এর পর ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসি। দেশে ফেরার পরে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তখন আমাকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিলো।

জেমস আনজুস: আবৃত্তির সাংগঠনিক চর্চা নিয়ে যদি কিছু বলেন...
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় :  আশির দশকের শুরুতে টিএসসি কেন্দ্রিক সাংগঠনগুলো আবৃত্তিচর্চার সূত্রপাত করে। প্রথমে আমরা আবৃত্তি ফেডারেশন করলাম। সেটা বেশি দিন কাজ করেনি। এরপর আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ করলাম। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম আমি। এ সময় সারা দেশে বিভিন্ন আবৃত্তি দল ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা থেকে প্রদীপ ঘোষ ও কাজী সব্যসাচী আসেন। নানা স্থানে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হতে থাকে। ফলে এর একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়। ডাকসুতে আবৃত্তি বিভাগ চালু হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে প্রথম জাতীয় আবৃত্তি উৎসব করি। আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, অভিনয় প্রভৃতির পাশাপাশি আবৃত্তি হত। আর এখন দর্শনীর বিনিময়ে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা আবৃত্তি শুনছে।







জেমস আনজুস : সে সময় তো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলছে...


ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : দলগত আবৃত্তি, সম্মেলক আবৃত্তির নতুন নতুন দল তৈরি হতে থাকে তখন। এত লোক সামিল হচ্ছে সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। তখন প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা। আমরা ট্রাকে করে আবৃত্তি করেছি তখন। ফুটপাতে, শহীদ মিনারে , মিছিল নিয়ে আবৃত্তি করতে করতে রাজপথে থেকেছি। সে আন্দোলনে কবিতা ও আবৃত্তির যে ভূমিকা, তা বিশাল। সংগঠিত  দলগুলো পুলিশের গুলির মুখে দাড়িয়েই আবৃত্তি করেতো।

জেমস আনজুস : সেই আন্দোলনের ধারাটা এখন কি রূপ?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কবিতাকে যেভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, পরবর্তীতে আসলে সেভাবে হয়নি। তবে বর্তমান সময়ে ওই সময়ের কবিতাগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আবৃত্তি করা হচ্ছে। স্বৈরাচার হটানোর পর গণতন্ত্র আসার পরও আবৃত্তি শিল্পীরা জেগেই ছিলেন, এখনও আছে।  গণ বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা সব সময়েই হয়েছে এবং হচ্ছে।

জেমস আনজুস : অনেক আবৃত্তি সংগঠন বর্তমানে কাজ করছে। সে তুলনায় কি আবৃত্তি শিল্পী উঠে আসছে?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : আবৃত্তি চর্চা হচ্ছে, সাংগঠনিক কর্মী তৈরি হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থাকে এত সংগঠন, প্রশিক্ষনের পরও ভাল আবৃত্তি শিল্পী তৈরি হচ্ছে কিনা। আসলে যে কোন শিল্পের প্রতি যদি নিবেদন না থাকে, ভক্তি না থাকে, তাহলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না। শিল্প নিয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টা না করলে প্রকৃত শিল্পী তৈরি হয় না।
এখন যারা কাজ করছেন, সবাই খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়। অল্প কিছু লিখেই তারা বিরাট কবি হতে চায়। অল্প কিছু পড়েই তারা টেলিভিশনে সুযোগ খোঁজে। আবৃত্তি শিল্পী হতে চায়, অভিনয় শিল্পী হতে চায়। অথচ ভিতরে তেমন চর্চা নেই। সবাই দৌড়োচ্ছে। কিন্তু সাধনা ছাড়া কখনই শিল্পী হওয়া যায় না।

জেমস আনজুস : শিল্পের এই জায়গাতে যে শূন্যতা গন্ধ ছড়াচ্ছে...
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : আসলে সময় সব সময় এক রকম যায় না। কোন বিষয় সাংঘাতিক গতিতে সব সময় এগুবে এটা হয় না। এটা শিল্পের ক্ষেত্রেও। পরিবর্তনটা থাকবে। হয়তো সময়ই তাকে আবার সাংঘাতিক করে তুলবে। তবে যে শিল্পী, তার সময়টা বুঝে নিতে হবে।

জেমস আনজুস : এখন কি আবৃত্তি করার মত কবিতা তৈরি হচ্ছে?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত যে অসাধারণ কবিতা লেখা হয়েছে, এখন হয়তো ওভাবে হচ্ছে না। এখন অবশ্যই ভাল কবিতা লেখা হচ্ছে, কিন্তু সেই সময়ে যে বাঁধ ভাঙা জোয়ার যে এসেছিল তা দেখছি না। আবৃত্তি শিল্পীদের আলোড়িত করবে এমনটা হয়তো হচ্ছে না। আমার নিজেরও এখন খুব একটা পড়া হয় না। তবু উল্লেখযোগ্য কবিতা হলে তো অশব্যই চোখে পড়বে। অগ্রজ কবিদের কবিতার প্রতি যে নিবেদন ছিল, তারা যে সময় দিয়েছিলেন, এখনকার কবিরা হয়তো সে রকম সময় দিচ্ছে না। তবে নতুন কিছু কবির কবিতা আমি  মঞ্চে পড়েছি। নতুন অনেক কবির কবিতা পড়ে, তাদের চেনানোর চেষ্টা করেছি। এজন্য আবৃত্তি শিল্পীদেরও দায়িত্ব আছে। নতুনদের কবিদের ভাল কবিতা তুলে আনার দায়িত্ব আবৃত্তিশিল্পীদেরও।

জেমস আনজুস: সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি বিভাগ যোগ হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি।
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : যখন আমরা বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠন করেছিলাম, তখন আবৃত্তিকে একটি শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোর দাবি ছিল আমাদের। এর একটা পেশাদারি অস্তিত্ব তৈরি হোক। নাটক, গান, অভিনয়সহ শিল্পকলার সকল শাখায় এখন প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। এতে করে আবৃত্তি শিল্পীদের একটি জায়গা তৈরি হল।

জেমস আনজুস: পেশা হিসেবে আবৃত্তি শিল্পকে কিভাবে বিবেচনা করবেন?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : আবৃত্তি শিল্প পূর্নাঙ্গ পেশা না। সব পেশার পেছনেই রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার দরকার আছে। আমাদের দেশে কিছু পৃষ্ঠপোষকতা, কিছু অনুদান পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ হয় না। তবে শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি বিভাগ চালু হওয়াতে আবৃত্তি শিল্প পেশা হিসেবে উঠে আসার একটা দারুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখনই হবে না, তবে আস্তে আস্তে বিস্তার হবে।

জেমস আনজুস : এতদিনের আবৃত্তি জীবনের স্বীকৃতি নিয়ে যদি বলেন...
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : ওভাবে তো বলা যায় না। তবে কন্ঠশীলন পদক, কবি মাহবুবুল আলম স্মৃতি পদকসহ অনেক রকম সম্মাননা পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও সম্মাননা পেয়েছি।

জেমস আনজুস : আবৃত্তি শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি বিষয়টি কি উপেক্ষিত, আপনি কি মনে করেন?
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় : নাট্য, অভিনয় সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি; যেমন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার-এসব ক্ষেত্রে আবৃত্তি বিষয়টা যুক্ত করা যায়। যারা আবৃত্তির পেছনে সারা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বা করছে তাদেরকে প্রাপ্য সমাদর দেওয়া উচিত। আবৃত্তির রাষ্ট্রিয় সমাদর এখনও হয়নি।

কোথাও নেই- ওস্তাদ পি. সি. গোমেজ (গমেজ)

পি.সি. গমেজ রচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ - †Rgm AvbRym evsjv‡`‡ki cÖL¨vZ D”Pv½m½xZ wkíx cvm Kvjm Pvj©m M‡gR(wc. ...